Skip to main content

রাইটার্স ব্লক

দিবাকর ক্রমাগত খারাপ লিখে চলেছিলেন।
সিগারেট বাড়ছিল।
বাড়ছিল প্রকাশকের বিরক্তি।

কিন্তু চেনা অস্বস্তি আর রাগ ছাপিয়ে দিবাকর রাত চিনতে শুরু করেছিলেন। স্তুপাকার ছেঁড়া কাগজে বিছানা ভার হয়ে যেত শেষের রাতে। ভোরের আগের সে অন্ধকারের ওজনই আলাদা, সে অন্ধকারকে আকাশ সহজে ধরে রাখতে পারে না। চুইয়ে নামে কালো, আকাশ থেকে জানালার শিক বেয়ে বিছানা বালিশে মিশে একাকার হয়ে যায়।

খারাপ লেখা দিবাকরকে রাতের টনটনে  দিকটায় টেনে নিয়ে  যেতে শুরু করেছিল।


**

সুতপার চিন্তা বাড়তে থাকে। চোখের সামনে দিবাকর ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে। দিবাকর অফিস যাওয়া বন্ধ করেছে আজ মাস চারেক হলো। দিনরাত হিজিবিজি লিখে চলেছে, পাতা ছিঁড়ে খাট মেঝেময় ছড়িয়ে চলেছে।  

রাতে ঘুম নেই।

জিজ্ঞেস করলেই শুধু একটাই কথা;
"পাবলিশারের তাগাদা আসছে। এবারে আমি একটা জুতসই উপন্যাস না দিলে ওদের কাটতি থাকবে ভেবেছো গো"?

**

আসলে দিবাকর বুঝতে পারে একটানা লিখে যাওয়াটাই তার জন্য এক মাত্র থেরাপি। আজ থেকে ঠিক চার মাস আগে সুতপার প্রবলেমটা টের পাওয়া যায়। অনেক কিছু গুলিয়ে যায় ওর। ওর মনে থাকে না যে দিবাকর একজন লেখক। সুতপার মনে থাকে না যে ও সুইসাইড করেছে বছর দুয়েক আগেই। সে ভুলে যায় যে সে দিবাকরের জ্যান্ত বৌ নয়। দিবাকর মুখের ওপর কিছু বলতে পারে না। যে নেই তার মুখের ওপর তুমি নেই বলার মত খারাপ কাজ হয় না। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে ভূতকে তো আর সাইকিলোজিকাল থেরাপিতে পাঠানো যায় না।

** 

"কে বলেছে তোমায় যে ভূতের মনোবিদ হয় না"?
মনোজিতের কথায় একটু ভরসা পেল দিবাকর। মনোজিতের সাথে আলাপটা নতুন। কিন্তু ভদ্রলোক এত অল্প সময়ে এত কাছের বন্ধু হয়ে উঠেছে; ভাবতেই বড় ভালো লাগে দিবাকরের। অমায়িক,  সপ্রতিভ। 

"আছে? তুমি ঠিক জানো মনোজিত"?

"না জানলে আর বলছি কেন? সামনের সপ্তাহে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার চেষ্টা করি। কেমন"?

"বাঁচালে ভাই। আসলে সুতপা মেয়েটা এত ভালো...ওকে এমন ভাবে সাফার করতে দেখলে বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে"।

"চিন্তা কোরো না। সে হয়ে যাবে। তোমার লেখালিখির খবর বলো বরং"।

"ওই। ব্লকটা কাটতে চাইছে না। তবে আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি। পাব্লিশাররা যে ভাবে চাপ দিচ্ছে, একটা কিছু না দাঁড় করাতে পারলেই নয়"। 

**

" দিবাকরকে কেমন দেখলে এবার মনোজিত"?

"ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে, ওর সেই ধারণাগুলো আমার হাজার কাউন্সেলিঙেও কাটছে নানা, বরং বদ্ধমূল হচ্ছে। তোমায় শক্ত হতে হবে সুতপা। তোমার সাপোর্টের ওপর সমস্তটা নির্ভর করছে"।

"আমার সাপোর্ট? মনোবিদ তো তুমি"।

"ইউ আর দ্য কী"।

"আমরাই ওর এ অবস্থার জন্য দায়ী। বিশেষত আমি"।

"নিজেকে অকারণে দোষ দিচ্ছ"।

"অকারণে? আমি দিবাকরের স্ত্রী, তাও তোমায় ভালোবেসেছি"।

" ভালোবাসা সিনেমার ডেফিনিশনে লিনিয়ার নয় সুতপা। আমিও ভালোবেসেছি তোমায়। কিন্তু দিবাকরের কথা ভেবে আমরা এক পাও এগোইনি কোনওদিন। ওর জানতে পারাটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট"।

"হি লাভড মি মনোজিত। পাগলের মত। আর ওই জানতে পারাটাই ব্রোক হিম। তুমি জানো সে জন্যেই দিবাকর আজ..."।

"ও'টা একটা দুর্ঘটনা ছিল সুতপা"।

**

জ্বরে দিবাকরের কপাল পুড়ে যাচ্ছিল, গোঙাচ্ছিল সে। যন্ত্রণায়। জলপট্টির শেষে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল সুতপা। 

**

দিবাকরের অবাক লাগে। রাতের অন্ধকার উপচে ঘরের ভিতরটা কেমন নরম হয়ে এসেছে। আবেশে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, কথার জড়িয়ে যাওয়াটায় রাত, লেখা আর স্নেহ খুঁজে পেলে সে।

কপালে সুতপার হাত কী ভালোই যে লাগছিল। ছোটবেলার বিকেল যেমন। শুধু সুতপার আঙুলগুলো বরফ শীতল। ও তো বেঁচে নেই, তাই অমনটা।

সুতপার জন্য বড় কষ্ট হয় দিবাকরের; আহা, মেয়েটা বড় ভালো। ভোর রাতের আবছায়ার মত স্নেহ। সুতপার এটুকু থাকাই বা কম কী?

উপন্যাস নয়, দিবাকর জানে যে এ রাইটার্স ব্লক কাটবে কবিতায়। তবে দিবাকর এও জানে যে কোনও লেখকই বাজারের চাহিদার হিসেবের ওপরে নয়। 

Comments

Soutrik said…
বড্ড কম পরিমাণ খাবার পাচ্ছি আজকাল আপনার থেকে। খিদে বাড়িয়ে দিয়ে এভাবে খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছেন কেন?

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু