Skip to main content

অমু ও বিকেল

বিকেল বেলা। এই চারটে সোয়া চারটে। ডিসেম্বরের বিকেল, রোদে ওম আছে তেজ নেই। ঝকঝকে আকাশ। ছাদটা বেশ বড়, অনায়াসে সত্তর-আশিজন লোককে বসিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে এমন। ছাদের এক কোণে টাবে প্রচুর পিটুনিয়া। নয় তলার ছাদ, রাস্তার গোলমালের আওয়াজ অল্পই আসে এখানে। ছাদের এক কোণে মাদুর পাতা, মাদুরের ওপরে নীল-সাদা ছাপা বেড কভার আর তার ওপরে একটা পাশবালিশ। পাশবালিশে ঘেঁষা একটা হজমি গুলির শিশি। মাদুরের এক কোণে আনন্দবাজারের শব্দছকওলা পাতাটা আধখোলা, তার ওপর আড়াআড়ি করে রাখা একটা ডট-পেন। তার পাশে একটা ট্রানজিস্টার।

অমু পাশবালিশে কনুই রেখে আধশোয়া হয়ে মাদুর জুড়ে ছিল। আধো তন্দ্রা ভারী আরামে রাখে মনটাকে। তার পরনে একটা খয়েরি রঙের কটকি ফতুয়া আর পাজামা। গায়ের ভাগলপুরি চাদরটা খুলে পাশে রাখা। অস্ফুট গুনগুনে আধা পদ্য আধা গানের মত গুনগুন করে চলেছে সে “ সে যে গান শুনিয়েছিল হয়নি সেদিন শোনা, সে গানের পরশ লেগে হৃদয় হল সোনা”। আর থেকে থেকে ঢুলছে। ছোটমামা বলে সিঙ্গেল মল্টের মত নেশা নাকি আর দু’টি নেই। অমুর মনে হয় ছোটমামা কোনদিন শীতের বিকেলে ছাতে আসেননি। পুওর সোল। 

এমন সময় ঝনাৎ করে মোবাইল ফোনে বেজে ওঠায় একরাশ নেশা-ভাঙা বিরক্তি নেমে আসে অমুর মুখে। নীলার ফোন। ধরতেই হল।


-“কী ব্যাপার?”। 
-“কী ব্যাপার মানে? তুমি আজ লালওয়ানি আঙ্কেলের অফিসে যাওনি কেন অমু? বিকেল তিনটেয় অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল...বাপি বলে রেখেছিলেন আঙ্কেলকে...”, নীলার গলায় আগুন।
-“ও, ওই চাকরির ব্যাপারে। আসলে, ছোটমামি মৌরলার ঝালটা এমন বানিয়েছিল। খেয়েই আর ডালহৌসি দৌড়তে মন করল না গো। নীলা, রাগ করো না প্লিজ”। 
-“হোয়াট দ্য হেল! মামার বাড়িতে বসে অন্ন ধ্বংস করছো। এম এ শেষ করেছ এক বছর হয়ে যাবে সামনের অগস্টে। এত কষ্ট করে বাবাকে বলে লালওয়ানি আঙ্কেলের বজবজের ফ্যাক্টরিতে অ্যাডমিন ম্যানেজারের চাকরিটা তোমার জন্য ম্যানেজ করে দিচ্ছিলাম। অ্যান্ড ইউ ডাম্ব অ্যাস...”। 
-“খবরদার নীলা। তোমার মত ডোনেশন দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করিনি, ক্যালক্যাটা ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে বেরিয়েছি উইথ ফ্লাইং কলর্‌স।ইংরেজি খিস্তি তোমার চেয়ে আমি বেশি জানি”।
-“একশো বার খিস্তি দেব। লজ্জা করে না বেকার হয়ে বসে...”। 
-“বেকার কাকে বলছ? ক্যাফে কফি ডের বিলগুলো আমার টিউশানির টাকাতেই মেটানো হয় স্যুইটি। তোমার বাপী বা লালওয়ানির পকেট কেটে নয়”। 
-“মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ অমু। তোমার কী লজ্জা হবে না?” 
-“লজ্জা কীসের? সাহিত্যের ছেলে হয়ে লালওয়ানির প্লাস্টিক বস্তা বানানোর ফ্যাক্টরিতে কেরানীগিরি করবো? আর সেই চাকরির ইন্টার্ভিউ দিতে অমন মৌরলা চচ্চড়ি খাওয়া মেজাজটুকু জলাঞ্জলি দিয়ে বাসে ট্রামে ঘুরে হদ্দ হব? আমায় কী নেদু পেয়েছ?”
-“তুমি জানো চাকরিটায় তোমার মাইনে-কড়ি কেমন হত? বাপী নিজে রেকমেন্ড করেছিল...”।
-“চাকরিটায় শীতের বিকেলে ছাতে মাদুর পেতে বসে ক্রসওয়ার্ড সল্ভ করতে দেবে নীলা?”।
-“হোয়াট?”।
-“মেজাজ খাপ্পা হলে তুমি ইংরেজিতে কথা বল কেন?”।
-“ইডিয়ট কোথাকার। বাপী ঠিকই বলত যে তুমি একটা রাস্টিক রাস্কেল। খবরদার আমার সাথে আর যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না, এই আমি ওয়ার্নিং...”। 

ফোন কেটে দিল অমু। 
পাশবালিশের তলা থেকে চাপা দেওয়া টিনটিনের বইটা বার করলে। তারপর পাশবালিশটা মাথায় দিয়ে লম্বা হয়ে চোখের সামনে মেলে ধরলে “কালো সোনার দেশে”। চার পাতা পড়ে বুকে পেতে নিলে বইটা। আর হাত বাড়িয়ে ট্রানজিস্টারটা চালিয়ে দিলে। 
ব্যাস। বিকেল চলে গেল শ্যামল মিত্রের হাতে। অমুর আর কোন দায়িত্ব রইলো না। 

শ্যামল ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেলেন, 
“আমি চান্দেরই সাম্পান যদি পাই, সাত সাগরে পাড়ি দিয়া তরে নিয়া যাই, আমি চান্দেরই সাম্পান যদি পাই”... 




বিকেলের আকাশের মেঘগুলো লালওয়ানির চাকরিটাকে বগলদাবা করে সন্ধ্যের অন্ধকারের দিকে ভেসে চললে। 
  

Comments

malabika said…
ইস্‌,খোলা ছাদে খালি মাটিতে চাদর পেতে না শুইয়ে অমুকে একটা চারপাই দিতে পারলে না?ওটা নাহয় ছাদেই পড়ে থাকত। ডিসেম্বরের শীতে খালি মাটিতে একটামাত্র চাদর পেতে শুলে কেমন ক্যাল্‌ক্যাল্‌ করে না?
Unknown said…
অ্যাডমিন ম্যানেজারের "চাকরটি"
"মৌড়লা" চচ্চড়ি

:)
Shakuntala said…
Nishchoi madur ache
Piya said…
Somosto somobedona sudhu Amur jonye? Kokhono Neelar dik theke bhebew to kichu likhte paren!

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু