Skip to main content

সপ্তপদী



কৃষ্ণেন্দু বাইক স্টার্ট দিতেই টের পেলে তার কাঁধ রিনার হাত দু’টো জাপটে ধরেছে। জ্যাকেটের উপর দিয়েও রিনার হাতের উষ্ণতা ছুঁয়ে গেল কৃষ্ণেন্দুকে। সামান্য ঘাড় ঘুরিয়ে মিচকি হাসি অফার করলে কৃষ্ণেন্দু, প্রত্যুত্তরে রিনার উচ্ছল হাসির আলোয় ভেসে গেল সে। প্রেমের গন্ধটা যে এত মিষ্টি সেটা আগে টের পায়নি কৃষ্ণেন্দু । না কি এটা রিনার গায়ের গন্ধ? একটা বুক হালকা করে দেওয়া ভালো লাগা তার মধ্যে। রিনা। ডাকসাইটে রিনা ব্রাউন তার প্রেমিকা। মফঃস্বল ঘেঁষা ফাঁকা রাস্তা, তবু বাইকের গতি মন্থরই রাখলো কৃষ্ণেন্দু। সন্ধ্যে নেমে আসছে দ্রুত, রিনারও ঘরে ফেরার বিশেষ তাড়া, তবু বাইক জোরে ছুটিয়ে সন্ধ্যেটার ওপারে গিয়ে কলকাতার ভিড়ে মিশতে ইচ্ছে করছিল না কৃষ্ণেন্দুর। তার গান গাইতে ইচ্ছে করছিল। তবে দুম করে গান গাওয়ার থেকে কাব্য ছকাটা কী বেশি ভালো হবে? রবীন্দ্রনাথের পর থেকে এ হুজুগটা বাঙালির প্রেমিক যুগলদের মধ্যে বেশ উঠেছে। কাব্যের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে সেখান থেকে বরং গানের দিকে চলে যাওয়া যাবে।


বাইকের ঘরঘর আর হাওয়ার শোঁশোঁ শব্দের জন্যে একটু গলা উঁচিয়ে কথা বলতে হয়। কৃষ্ণেন্দুকে খোলতাই গলায় আদর এনে জিজ্ঞেস করতে হল “আচ্ছা রিনা, এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হত তুমি বলো তো?”

-“তাহলে ধরে নিতে হবে যে আমরা চক্রাকারে ঘুরছি সোনা”
-“ও হ্যাঁ। ইয়ে তাই তো”, কৃষ্ণেন্দু একটু বিরক্ত হলে, “যাক গে, ইয়ে, বল দেখি, যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয়...”
-“ কৃষ্ণেন্দু, ওই অস্ট্রিয়ান ভদ্রলোক স্বপ্ন নিয়ে সাঙ্ঘাতিক কী সব রিসার্চ করেছেন জানো তো। ওই যে ফ্রয়েড না কী যেন। ওর রিসার্চের ব্যাপারে পড়লে জানতে, স্বপ্নের দেশ ব্যাপারটা কত গোলমেলে হত”
-“তাই তো। তাই তো। আচ্ছা বেশ।আচ্ছা, ধর এক রাখাল, কোন এক সবুজ উপত্যকার মধ্যে বাঁশি বাজাতে বাজাতে চলেছে। তার বাঁশির ঘর ছাড়া সুরে আর প্রকৃতির সবুজে যদি আমার মন মিশে যায়...”
-“জেন্ডার ফ্লুইডিটির কেস কৃষ্ণেন্দু”।
-“কী ডিটি ?”
-“জেন্ডার ফ্লুইডিটি। তুমি আনসিওর হয়ে পড়ছ নিজের জেন্ডারের ব্যাপারে কৃষ্ণেন্দু। রাখালে বাঁশির সুর, সে তো রাধার হৃদয়কে ঘরছাড়া করবে, তোমার মাথাব্যথা হবে কেন তাতে?”
-“আচ্ছা, ইয়ে রিনা। অন্য কথা বলি বরং। ধর, যদি আমি এখন একটা গান গাই আর সে গানের সুর যদি নীল আকাশের ওই দূর সীমা ছাড়িয়ে হারিয়ে যায় আর প্রাণে যদি সে গানের রেশ রয়ে যায়? তবে? কেমন হত বল তো?”
-“ কৃষ্ণেন্দু, কাম অন। বাইকের আওয়াজ ছাপিয়ে তোমার কথা শুনতে আমাকেই হিমশিম খেতে হচ্ছে আর তোমার গানের শব্দ যাবে অ্যাক্রস দা হরাইজন? স্টপ টকিং ক্রেজি ডিয়ার”।

কৃষ্ণেন্দু বাইকে স্পীড তুললেন। জ্যাকেটের ভিতরে দরদর করে ঘামছিলেন তিনি। কতক্ষণে যে পথ শেষ হবে সে চিন্তায় তখন তিনি মশগুল।

**

-“এসো কৃষ্ণেন্দু, কী ব্যাপার হঠাৎ না বলে কয়ে বাড়ি চলে এলে? সব ঠিকঠাক তো?”।
-“একটা জরুরী দরকারে আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি বাবা। একটা বিশেষ ব্যাপারে আপনার সাহায্য চাই। তবে কী সাহায্য সেটা বলার আগে আপনাকে ঘটনাটা বলে নেওয়া দরকার”।
-“বলো। শুনছি”।
-“আজ্ঞে আপনি কলকাতার ব্রাউন সাহেবের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন। আমি তার মেয়ের প্রেমে পড়েছি। এই কিছুদিন যাবত। তা মিস্টার ব্রাউন আমায় বললেন তার মেয়ে রিনাকে আমি বিয়ে করতে চাইলে আমায় খ্রিষ্টান হতে হবে”।
-“তা তুমি কী করলে তারপর”?
-“আজ্ঞে আমার কোন উপায় ছিল না খ্রিষ্টান না হয়ে। মানে ব্রাউন সাহেব বন্দুক-টন্দুক মাঝেমাঝেই চালিয়ে থাকেন কী না। তাই খ্রিষ্টান না হওয়াটা ভারী চাপের মন হল”।
-“তা এ কথাটা তুমি এত দ্বিধার সঙ্গে বলছো কেন বাবা কৃষ্ণেন্দু। বেশ করেছো। প্রেমের জন্যে ধর্ম। উলটোটা তো নয়। ধর্ম প্রেম আগে নয়। প্রেমই সর্ব শ্রেষ্ঠ পুজো। আমি গর্বিত বাবা কৃষ্ণেন্দু যে তুমি প্রেমকে ধর্মের চেয়েও উঁচু সিংহাসনে বসিয়েছো। এবার বলো তুমি আমার কী সাহায্য চাও”।
-“ইয়ে। মানে। আমায় বাঁচান আপনি বাবা। ব্রাউন সাহেবের চাবকানির ভয়ে খ্রিষ্টান হয়েছি বটে কিন্তু রিনাকে আমি বিয়ে করতে একদম চাই না। চাই না, চাই না, চাই না”।
-“সে কী বাবা কৃষ্ণেন্দু। কেন?”।
-“সে মেয়ে কাব্যি আর বাংলা রোম্যান্স কিস্যু বোঝে না বাবা। স্বপ্নের দেশের কথা বললে ফ্রয়েড ঝাড়ে। এ বিয়ে করলে আমি ঝাড়ে যাব বাবা। বাঁচান আমাকে”।
-“কিন্তু আমি কী করে এ কাজে তোমায় সাহায্য করবো কৃষ্ণেন্দু?”।
-“আপনি একবারটি রিনা ব্রাউনের সঙ্গে দ্যাখা করে তাকে কড়া গলায় বলুন যে এ বিয়ে আপনি কিছুতেই মেনে নেবেন না। এ বিয়ে হলে আপনি আমায় ত্যাজ্য পুত্র করবেন। ব্যাস, আপনি এ কথা একবার ভেজা গামছার মত মুখ নিয়ে রিনার সামনে বলতে পারলেই বিয়ে যাবে ভেস্তে। প্লীজ বাবা প্লীজ। বাঁচান আমাকে”।
-“তুমি আমায় অন্যায়ের দিকে ঠেলছো কৃষ্ণেন্দু, কিন্তু বৃদ্ধ পিতার আর কিই বা উপায়। পুত্রের মুখ চেয়ে এ অকাজও আমায় করতে হবে”।

**


Comments

malabika said…
এটা কিন্তু দারুণ হয়েছে। সপ্তপদীর এই পরিণতি! ভাবা যায় না কিন্তু এটাই বোধহয় বাস্তব।

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু