Skip to main content

নিরালাপুর

দু’মাইল হেঁটে এখানে আসতে হয় নিশিকান্তবাবুকে। বাড়ি থেকে বেশ দূরে। বসতি এখানে নেই। রেল লাইন আছে। এক কোণায় একটা পুকুর, শাপলায় ভরা। ঝোপঝাড় আধো জংলা জায়গা। ট্রেন চলাচল বিশেষ নেই এ লাইনে। আপ আর ডাউন মিলে দিনে পাঁচটা লোকাল ট্রেন আসা যাওয়া করে। একটা সিমেন্টে বাঁধানো উঁচু জায়গা মত আছে ডাউন লাইন ঘেঁষে। সেখানে বসতে ভালোবাসেন সত্তর বছরের নিশিকান্ত। গায়ে শাল, গলা কান জড়িয়ে মাফলার, হাতে লাঠি। বাহাত্তর বছর হতে চললো, হাতে লাঠি তো থাকবেই। তবে এ বয়েসেও যে দৈনিক চার মাইল হন্টন চালিয়ে যেতে পারছেন, সেটাই বা কম কী। 

এ জায়গাটা বেওয়ারিশ, কেউ তেমন আসা যাওয়া করে না। তাই নিজেই এ জায়গার একটা নাম দিয়ে নিয়েছেন নিশিকান্ত; নিরালাপুর। ঠিক বিকেল চারটে বাজলে নিরালাপুরে এসে পৌঁছন নিশিকান্তবাবু। চারটে বত্রিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মধ্যে আপ লাইনে একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন পাস করে। সেটা চলে গেলে উঠে পড়েন নিশিকান্তবাবু। ফ্লাস্কে করে চা নিয়ে আসেন। পকেটে থাকে দু’টো বিস্কুট। কাঁধের ঝোলা থেকে আনন্দবাজার বের করে পড়তে শুরু করেন, খবরের কাগজ বিকেলে পড়ার অভ্যাসটুকু তার বহুদিনের। কাঁধের ঝোলায় থাকে ছোট ট্রানজিস্টার। এ যন্ত্রটা আজ থেকে বারো বছর আগে শিলিগুড়ি থেকে কিনেছিলেন নিশিকান্তবাবু। এখনও দিব্যি চলছে। আকাশবাণীতে আধুনিক বাংলা গানের আসর বসে বিকেল চারটে থেকে, চড়ুই শালিকের কিচিরমিচিরে মিশে যায় রেডিওর গান। বেশির ভাগ দিনই ব্রজবালা এসে হাজির হয় লেজ নাড়তে নাড়তে। ব্রজবালা নামটা নিশিকান্তবাবুরই দেওয়া। নেড়ি হলেও থিন অ্যারারুটে আপত্তি নেই ব্রজবালার। নিশিকান্তবাবু না ওঠা পর্যন্ত পাশে এলিয়ে শুয়ে থাকে ব্রজবালা, সামান্য থিন অ্যারারুটেই অনুগত হয়েছে সে। 

চারটে বত্রিশের পর পরই যখন প্যাসেঞ্জার ট্রেন চলে যায়, নিশিকান্তবাবু পাততাড়ি গুটিয়ে নেন। লেজ নাড়তে নাড়তে চলে যায় ব্রজবালা। আকাশ বিকেল-লালচে হয়ে আসে। ট্রেন যাওয়া লাইনের মৃদু কাঁপুনি তখন অল্প রয়ে যায়। ট্রেনটার চলে যাওয়া নিশিকান্তবাবুর কাছে আত্মীয়র মত হয়ে গেছে। ট্রেনটার চলে যাওয়ার ঝমঝম তার কাছে একমাত্র আপনজনের মত।

বাড়ি ফিরেই কান্না পায় নিশিকান্তবাবুর। এটাও নিয়মিত।স্ত্রী গীতালি নেই আজ পাঁচ বছর হল। খোকা ব্যাঙ্গালোরে। প্রতিবেশী বন্ধু হরেন সমাদ্দার বা নীলমণি সেনগুপ্ত দু’জনেই হাওয়া আজ বেশ ক’বছর। নিশিকান্তবাবু আছেন। রোজই ভাবেন, আর নয়, এভাবে থেকে লাভ নেই। ইনসমনিয়ার কল্যাণে ঘুমের বড়ির অভাব নেই নিশিকান্তবাবুর সংগ্রহে। সাহসের অভাব আছে তেমনটাও নয়, নিশিকান্তবাবু জানেন সেটা। কিন্তু প্রত্যেকবারই তার মনে হয়, আহা রে, ব্রজবালা থিন অ্যারারুট বড় ভালোবাসে। আর কয়েকটা দিন অন্তত ব্রজবালাকে বিস্কুট খাইয়ে আসতে ইচ্ছে করে নিশিকান্তবাবুর। থেকে যেতে হয়।

ব্রজবালাও যে কতটা একা সে খবরটুকু টের পাওয়া হয়ে ওঠে না নিশিকান্তবাবুর। নিরালাপুরেই লাইনের ধারে বেওয়ারিশ জন্ম, এবং জন্মাবধি ব্রজবালার যন্ত্রণা হল যে তার মানবজন্মের স্মৃতিটুকু মুছে যায়নি। মানব জন্মের স্মৃতি বয়ে কী কুকুরে জীবনে মানিয়ে নেওয়া সম্ভব? মোটেই নয়। তাই রোজ বিকেলে সমস্ত সাহস জড় করে লাইনের ধারে চলে আসে ব্রজবালা, ট্রেন ধেয়ে আসলেই তার সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে যন্ত্রণা দূর করতে। কিন্তু পারে না সে। রোজই ভদ্রলোক আসেন, এসে বসেন চায়ের কাপ আর আনন্দবাজার নিয়ে। বরাবরের মত। তাকে আদর করে কাছে ডাকেন, একটা বিস্কুট মুখে গুঁজে দেন। শুধু গীতালি বলে না বলে ব্রজবালা বলে ডাকেন। এটুকুই যা দুঃখ। ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়া আর হয় না ব্রজবালার।         

Comments

malabika said…
নিশিকান্তের ব্রজবালা থাকাটা নাহয় ভাগ্যিস্‌ বলে চালানো যায়, ব্রজবালার নিশিকান্ত থাকাটাকে কি বলা যায় বলো দেখি? ভারি মুস্কিল। এখানে আবার পূর্বজন্মের স্মৃতির একটা হাল্‌কা হাওয়া! বাপ্‌রে।
debalina said…
Onnorokom premer golpo...ha ha

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু