Skip to main content

পুলিন আর সমুদ্র



পুলিন ছিলেন মেজমামার ভক্ত৷ ছেলেবেলায় মামার সঙ্গে কতবার সমুদ্রের ধারে ছুটি কাটাতে গেছেন৷ পুরীর পড়ন্ত বিকেলে মেজমামা সৈকতে এসে দাঁড়াতেন হাঁটু পর্যন্ত পাজামা গুটিয়ে। সমুদ্রের দিকে বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়তেন৷ ঢেউয়ের আরামদায়ক আসা-যাওয়ায় গোড়ালি ভিজত বারাবার, নরম হয়ে আসত মন৷ গপ্পিয়ে মানুষটা নিশ্চুপ হয়ে আসতেন, মুখে লেগে থাকত ভালোবাসাবাসির হাসি৷ হাওয়ার ঝাপটার পাশাপাশি ঢেউ ভাঙার শব্দ, ভেজা বালির গন্ধ আর সন্ধ্যের আকাশের রঙ সমস্তটুকুই মেজমামা নিজের মধ্যে শুষে নিতেন৷ সে নাকি এক তপস্যার মত ব্যাপার৷ চল্লিশ বছর আগে পরীক্ষায় বসে কষতে না পারা অঙ্কের সলিউশন মনের মধ্যে উঁকি দেয় সে সময়৷ সতেরো বছর আগে হারিয়ে ফেলা ফাউন্টেন পেনটা আদতে কোথায় ফেলে এসেছিলেন তা ঠিক মনে পড়ে যায়। রীতিমত ম্যাজিক! 

পুলিন নিজে অবশ্য সে ম্যাজিকের তল পেতেন না৷ মেজমামা চলে যাওয়ার পরেও তাঁর স্মৃতির টানে বারবার সমুদ্রের দিকে ঘুরতে গেছেন পুলিন৷  ট্রাউজার গুটিয়ে দাঁড়িয়েছেন সমুদ্রে, পা ভিজিয়েছেন ঢেউয়ে৷ কিন্তু মেজমামার সেই সমুদ্র-নির্বাণ আয়ত্ত করা যায়নি৷ বারবার নিজেকে সান্ত্বনা দিতে হয়েছে, মানুষ দিনদিন ক্ষুদ্র হয়ে পড়ছে; মনের ফ্লেক্সিবিলিটি কমে আসছে, আত্মার কোয়ালিটি গাম্বাট হয়ে পড়ছে৷ তার আর মেজমামার মত তপস্বী হওয়া হল না৷ মেজমামার মামা নিশ্চয়ই সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে লেভিটেট করতে পারতেন৷ তাই হবে হয়ত।  ধান্দাবাজি বাড়ছে আর মানুষের মানুষেমি কমে আসছে৷ এই থাম্বরুলটাই নিজেকে বারবার বোঝাতেন পুলিন৷

কিন্তু সেই ভুল ভাঙলো আলিসাহেবের এই আড়ম্বরহীন মাংস-রুটি-কাবাবের দোকানটির খোঁজ পেয়ে৷ প্রতি শনিবার এ দোকানের সামনে বেঞ্চিতে বসে মাংস রুটি আর অল্প কাবাব খেয়ে রাতের খাওয়া সারেন পুলিন৷ কিন্তু এ দোকানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শনিবার রাতের মাখোমাখো রোম্যান্সের চেয়েও অনেক বেশি নিবিড়৷ চাকরীর টানে এই দূর-শহরে ঠাঁই খুঁজে পাওয়ার পর থেকেই আলিসাহেব তার বন্ধু৷ আলি সাহেব কবিতা আর ইতিহাস ভালোবাসা মানুষ, কাবাব-মাংসরুটিতে তাকে বাঁধা যাবে না৷ পুলিনের পেট তেমন মজবুত নয়, হপ্তায় একদিনের বেশি মোগলাই খানা তার সয়না৷ কিন্তু হপ্তায় বার-তিনেক; সন্ধ্যের পর আলিসাহেবকে সেলাম না ঠুকলে তাঁর চলেনা৷ এক কাপ চা খেতে খেতে আলিসাহেবের শায়েরি আর গল্প শোনা। গপ্প সেরে আলিসাহেব ফিরে যান খদ্দের সামলাতে৷ 

ঠিক তারপর, কিছুটা দূরে সরে গিয়ে খানিকক্ষণের জন্য পুলিন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন আলিসাহেবের মাংসের কড়াইয়ের দিকে৷ আলিসাহেবের আত্মমগ্নতা, খদ্দেরদের হইহই, মোগলাই ঝোলের সুবাস, উনুনের তাপ; এই সমস্ত কিছু মিলিয়ে যে অ্যালকেমি, সে'টা পুলিনকে জাপটে ধরে৷ সে মুহূর্তে পুলিন টের পান বুকের মধ্যে যেন অজস্র জানালা খুলছে, বিভিন্ন মনকাড়া সুর তৈরি হচ্ছে৷ মনকেমন করা সব অচেনা সুর৷ অথচ বাথরুমের আবডালেও পুলিনের গলা দিয়ে গান বেরোয় না৷ আস্তে আস্তে মাথায় ঝিম লাগে পুলিনের, টের পান পায়ে ঢেউ এসে ঠেকছে, পায়ের নীচে ফুটপাথের বদলে নরম বালি৷ মনে পড়ে মেজমামার গায়ে লেগে থাকা পরিচিত গন্ধটা; খবরের কাগজ আর সিগারেট মেশানো৷ মনের পড়ে মা দুপুরবেলা উপুড় হয়ে বই পড়ছে, আর বছর পাঁচেকের একটা চঞ্চল ছেলে মায়ের শাড়ির আঁচল টেনে নিয়ে মাথায় পাগড়ি বাঁধার চেষ্টা করছে৷ 

এমনই এক সন্ধ্যেয় ব্যাপারটা হুশ করে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল পুলিনের কাছে৷ আরে, মেজমামার সমুদ্র-ম্যাজিকের তল পাওয়া গেছে যে৷ সবার সমুদ্দুর তো বে অফ বেঙ্গলে পড়ে নেই৷ নিজের সমুদ্র নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে। আর সে খোঁজ একবার পেলেই কেল্লা ফতে!

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু