Skip to main content

বাংলার ক্লাস



বাংলায় আমি চিরকালই নড়বড়ে। হাতের লেখা মারাত্মক খারাপ, বানানে বৃহস্পতি। অবশ্য অন্যান্য ভাষায় আমার অবস্থা আরও করুণ। সত্যি বলতে কী; ভাষাগত ভাবে আমি চিরকালই জুবুথুবু৷ তা সত্ত্বেও  ব্লগটা শুরু করেছিলাম নেহাতই টেকনোলজির মায়া কাটিয়ে উঠতে না পেরে৷ ২০০৭ নাগাদ ব্লগ ব্যাপারটা বেশ নতুন৷ উঠলো বাই তো করে নিজের একটা কটক-যাই-ওয়েবসাইট দাঁড় করিয়ে ফেলা যায়, যা কিছু হিজিবিজি লিখেও ফেলা যায়৷ এ লোভ পাশ কাটিয়ে চলে আসা সহজ নয়৷ সেই থেকে বংপেন৷ পরে বহুবার মনে হয়েছে নামটা কেমন যেন; বং এবং পেন, দু'টোর কোনওটাতেই বাংলার ব'ও নেই। কিন্তু নামটা তদ্দিনে ডাকনামের মত হয়ে গেছে৷ বাবাই, টুকাই, পাপাই; এই ধরণের ডাকনামের মানে নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও মানেই হয়না৷ তেমনই, আমার মাথার মধ্যে বংপেনও খানিকটা ওই বাবাই-পাপাইয়ের মতই একটা ডাকনাম৷ 

ব্লগে প্রথম লেখা শুরু করেছিলাম ইংরেজি ফন্টে৷ মানে লিখতাম বাংলাতেই, কিন্তু রোমান হরফ ব্যবহার করে৷ সে'খানে বাংলা হয়ে যেত Bangla। এর মূল কারণ দু'টো৷ এক, তখনও অভ্র কীবোর্ড ততটা ছড়িয়ে পড়েনি বা আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি৷ ওয়ার্ড ফাইলে বাংলা টাইপ করা একটা বিশ্রী অভিজ্ঞতা ছিল৷  দুই, পরীক্ষার খাতার বাইরে বাংলা আদৌ লেখার অভ্যাস ছিল না৷ সে সময় হাতে স্মার্টফোন না থাকায় বাংলা টাইপ করার ব্যাপারটা নেহাত এলেবেলে ছিল না৷ সবচেয়ে বড় কথা, একটানা বাংলায় লিখব ভাবলেই গলা শুকিয়ে আসত৷ 

কাজেই রোমান হরফে বাংলা লিখে ব্লগের শুরু৷ তখন লেখা ব্যাপারটাকে আদৌ পাত্তা দিচ্ছি না। ইন্টারনেটে লেখা ভেসে উঠছে; থ্রিল সে'টুকুই৷ কিন্তু এরপরেই টের পেলাম আদত ম্যাজিকটা। সোশ্যাল মিডিয়ার ম্যাজিক৷ আমরা (আমিও) সোশ্যাল মিডিয়াতেই অনবরত দুঃখ করে চলি যে এই মাধ্যমটা ভীষণ নির্মম। মানুষ এ'খানে একে অপরের কলার টেনে কাদায় গড়াগড়ি যাচ্ছে, এ ওর বাপ তুলে গাল দিচ্ছে, ও এর গুষ্টির পিণ্ডি চটকাচ্ছে৷ গুজব আর গালিগালাজে পরিপূর্ণ চারদিক৷ অথচ ফেসবুক ট্যুইটারের নেশা ছাড়তে না পেরে আমরা ক্রমাগত হাহুতাশ করে চলেছি৷ 

যাকগে, যে ম্যাজিকের কথা বলছিলাম। এই প্রবল গোলমেলে ইন্টারনেটের জগতে ব্লগের ঝাঁপ খুলে টের পেলাম দু'চারজন মানুষ পাশে এসে বসতে শুরু করেছেন (ইয়ে, ভার্চুয়ালি), লেখার দিকে চোখ বুলোতে শুরু করেছেন৷ আর সবচেয়ে বড় কথা; কথাবার্তা শুরু হল৷ লেখা নিয়ে, বাংলাভাষা নিয়ে। একসময় টের পেলাম আমারই বয়সী এক ছোকরা মাঝেমধ্যেই ব্লগে কমেন্ট ভাসিয়ে দিয়ে চলে যায়, "ভায়া, রোমান হরফে নয়৷ ইউনিকোডে লেখো৷ বাংলায় লেখো"৷ যাই লিখি ছাই একই কমেন্ট৷ খানিকটা বাধ্য হয়ে খোঁজ নিলাম ইউনিকোড ব্যাপারটা কী, আবিষ্কার করলাম অভ্র৷ একটা বিচ্ছিরি দুরুদুরু নিয়ে শুরু হল অভ্রতে লেখা৷ সেই ছোকরাটি অবশ্য নিজের 'সুপারভিশন' সরিয়ে নেয়নি৷ ওর নাম রোহণ, ওর মত বাংলাপ্রাণ মানুষ আমি খুব বেশি দেখিনি (ইয়ে, আমি কতটুকুই বা দেখেছি)।  রোহণের (বলাই বাহুল্য ওর একার নয়) সৃষ্টিসুখই বাংলা প্রকাশনায় এখন নতুন হাওয়া (ততটাও নতুন নয় আর৷ রীতিমত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে)।

কপাল বটে আমার৷ হিজিবিজি যা কিছু লেখা, কিছু সহৃদয় মানুষ যত্ন করে পড়তেন এবং খেটেখুটে প্রুফ রীড করতেন। কারুর কারুর সঙ্গে আলাপও হল৷ ক্রিকেট লিখিয়ে অভিষেকদার সঙ্গে আলাপও ওই ব্লগেরই মাধ্যমে৷ অভিষেকদা রীতিমতো মাস্টারি করেছে বেশ কিছু বছর। লেখার ভুলত্রুটিতে বিরক্ত হয়ে বাড়ি এসে পেটানোর হুমকিও দিয়েছে৷ কিন্তু হাল ছাড়েনি৷ বানান এখনও গুলিয়ে যায়, ভাষা এখনও নড়বড়ে, তবে ভুলের ভয়াবহতা খানিকটা কমেছে মূলত অভিষেকদার বকুনির ভয়ে। (লেখায় গোলমাল আছে এখনও বিস্তর, খানিকটা কমেছে, এই যা)৷ 

পত্রভারতীর ত্রিদিববাবু প্রবল ব্যস্ততার মধ্যেও বংপেনের গল্প পড়েছেন আর ধৈর্য ধরে ভাষা এবং স্টাইলের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিয়েছেন৷ সে আলাপও ইন্টারনেট ধরে। আমায় সামনে বসিয়ে একদু'বার লেখা পড়েছেন৷ প্রতিবারই মনে হয়েছে পত্রপাঠ বিদেয় করবেন৷ কিন্তু ওই, লাখটাকার কপাল; ভদ্রলোক কোনওবারই তিতিবিরক্ত হননি৷ " ও এমন কিছু নয়" ভাব করে ভুলচুকগুলো দাগিয়ে দিয়েছেন৷ আমি সমৃদ্ধ হয়েছি। 

সবচেয়ে বড় ব্যাপার, বংপেন ব্লগে লেখা পড়ে বহু মানুষ প্রুফরীড করে আমার লজ্জা ঢেকেছেন (চেষ্টা করেছেন অন্তত)৷ কত মানুষ ভালো বাংলা বইয়ের খোঁজ দিয়েছেন৷ ব্লগতুতো সম্পর্কের কত সহৃদয় মানুষ ভালো বাংলা সিনেমা দেখিয়ে ছেড়েছেন৷ কত মানুষ লেখার ভুল ধরিয়ে দিয়ে সরে পড়েননি, ভাষাগত বদঅভ্যাস ছাড়ানোর সহজ উপদেশ দিয়ে উপকার করেছেন৷ স্বীকার করে নিই, বংপেন ফেসবুকের পেজের কমেন্ট সেকশনের মত ধারালো প্রুফরীডার না থাকলে আমি সত্যিই বড় বিপদে পড়তাম। 

মোটের ওপর, বংপেন সম্ভবত গোটাটাই 'ক্রাউড ফান্ডেড'৷ কেউ বানানের লেগো টুকরো এগিয়ে দিয়েছেন, এগিয়ে দিয়েছেন ভাষার স্টাইলের লেগো টুকরো। এ সমস্ত জুড়েটুরে দাঁড়িয়ে রয়েছে বংপেন; মচমচ শব্দ আছে কিন্তু ভেঙেচুরে পড়ছে না৷ এই ব্লগের সূত্রেই বাংলাভাষা প্রসঙ্গে বিস্তর ধমক, কানমলা, গাঁট্টা, আর স্নেহপ্রাপ্তি ঘটেছে। সে'সব নিয়েই আমার বাংলা-শিক্ষা। বংপেন থেকেই জুটেছে বাংলার 'মাস্টারমশাই-দিদিমণি'দের৷ 

পনেরো বছর আগের তুলনায় ভুলভ্রান্তি খানিকটা কমেছে (তবে আবারও বলি, কমেছে মানে স্রেফ ওই সমুদ্র থেকে দু'চার মগ জল সরেছে আর কী)। আরও কমবে, আরও একটু ভালো বাংলা লিখতে শিখব ধীরেসুস্থে; উচ্চাশা বলতে সে'টুকুই৷ 

ধন্যবাদ। 

আর, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের শুভেচ্ছা৷

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু