Skip to main content

দেবু দত্তর মানিব্যাগ



শ্রদ্ধানন্দ পার্কের কাছাকাছি পরেশের রুটি-ঘুগনির স্টলে মৌজ করে পেটাই পরোটা পেটাবার তাল করে দোকানের বেঞ্চিতে এসে বসেছিলাম৷ এমন সময় সিরিয়াল কিলার দেবু দত্ত পাশে এসে বসে দু'স্লাইস পাউরুটি, চারটে ডিমসেদ্ধ আর দেড় বাটি ঘুগনির অর্ডার দিলে। আমার চোয়াল গেল ঝুলে, আরিব্বাস। আজ কার মুখ দেখে বেরিয়েছিলাম! 

যে' দেবু দত্তকে লালবাজার ইন্টারপোল সবাই হন্যে হয়ে খুঁজছে, সে কিনা আমার পাশে বসে ঘুগনিতে পাউরুটি ডুবিয়ে খাবে? অবিশ্বাস্য যে। সোজাসুজি তাকানোর আদেখলামোটা আমার না-পসন্দ, কিন্তু উত্তেজনা সামাল দেওয়া দায়৷ দেবু দত্তকে চিনতে পারা মামুলি ব্যাপার নয়। এই যেমন আজ খয়েরি প্যান্ট আর গোলাপি চেক হাফশার্ট পরে বসে আছে, থুতনিতে কাটা দাগ, কাঁচাপাকা পেল্লায় গোঁফ, নাদুস-নুদুস চেহারা, মাথা আলো করা টাক, গালে অমায়িক হাসি; হয়ত পরিচয়  জিজ্ঞেস করলেই জানান দেবে যে সে নাকি বঙ্কুবিহারি বয়েজ হাইস্কুলের ভূগোল শিক্ষক হরেন মল্লিক। অথচ আগামীকালই হয়ত ভদ্রলোককে দেখা যাবে হাইকোর্ট চত্ত্বরে; তালপাতার সেপাইয়ের মত হাড়গিলে চেহারা। স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে ডাব বিক্রি করছেন; শশব্যস্ত উকিল আর উদ্ভ্রান্ত মক্কেলরা তার খদ্দের৷ 

কিন্তু আমি তো আর পুলিশ বা গোয়েন্দা নই, দেবু দত্তের ফাঁকিতে নিয়মিত পা দিয়ে আমার মাইনে জোটেনা৷ আমি কলকাতার সেরা পকেটমার। বিরানব্বুইয়ে বারুইপুরে দ্য গ্রেট ভোলা সান্যাল ট্রেনে কাটা যাওয়ার পর পকেটকাটার শিল্পে সেরা আমিই৷ এখন বয়স হয়েছে বটে, তা'বলে চোখের ধার কমেনি। দেবু দত্তের ডান কবজির কাছে আড়াই ইঞ্চির কাটা ঘাটা আমি বিলক্ষণ চিনি, ভেক ধরে এ'শর্মাকে টুপি পরানো সম্ভব নয়।

এসো চাঁদু দেবু, এ'বার শখ পূর্ণ করি। কোন শখ? বলি৷ জীবনে কম পকেট কাটিনি বুঝলেন৷ পলিটিকাল নেতা, ফিল্মস্টার, ক্রিকেটার...সেরা মানুষজনের পকেট চিরেছি ব্লেডের পালক বুলিয়ে।  বলাই বাহুল্য, কখনও ধরা পড়িনি। আর বহুদিন এ লাইনে হল, আখের গুছিয়ে নেওয়া গেছে দিব্যি৷ এখন আর টাকাপয়সার জন্য পকেট কাটিনা৷ স্রেফ শিল্পের জন্যই শিল্পী শুধু। তা এই গোটা শহরে আর মাত্র একজনই শিল্পী আছে যে শুধু শিল্পের জন্য নিজের জীবন উজাড় করে দিয়েছেন; ওই সিরিয়াল কিলার দেবু দত্ত। বেয়াল্লিশটা হাড়হিম করা মার্ডার অথচ সমস্ত ফেলু-ব্যোমকেশ মিলে তার তল পেলো না৷ আমি ঠিক করেছি যে দেবু দত্তের পকেট মেরেই আমি পকেটমারির ব্র‍্যাডম্যানত্ব স্পর্শ করব।  

আজ হাতের কাছেই দেবু দত্তকে পেয়ে মন চলকে উঠেছে৷ চুলোয় যাক পেটাই পরোটা, দেবু দত্তের পকেট আজ ফাঁক না করলেই নয়৷ 

***

দেবুর পকেটস্থ মানিব্যাগ ছোট্ট একটুকরো মেঘের মত তুলে নিয়ে পরেশের দোকান থেকে নিঃশব্দে সরে পড়লাম৷ হাঁফ ছেড়েছিলাম এক্কেবারে শেয়ালদার কাছে এসে। স্টেশনের কাছে একটু ছায়া খুঁজে দাঁড়িয়ে নিজের পকেট থেকে বের করলাম দেবু দত্তর সেই মানিব্যাগ৷ কালো চামড়ার অতি সাদামাটা মানিব্যাগ৷ টাকাপয়সার দরকার আমার নেই, তবু ডিসিপ্লিনের খাতিরে সে মানিব্যাগ ঘেঁটে দেখা দরকার৷ 

কী আশ্চর্য৷ মানিব্যাগের ভিতরে একটাও টাকা নেই। কোনও প্রসাদী ফুল, পাসপোর্ট সাইজ ফটো, পুরনো বাসের টিকিট, বা কোনও ডেবিট কার্ডও নেই৷ আছে শুধু একটা চিরকুট৷ আর সে চিরকুট পড়া শুরু করার পর চারপাশে দুনিয়াটা কেমন বিশ্রী ঘোলাটে আর অস্পষ্ট হয়ে পড়ল।

**

ভাই রবি,

ঘাট হয়েছে তোমায় খুন করে। দু'একপিস আমার হাতে খুন হওয়া আত্মা যে আমায় আওয়াজ দিয়ে চমকায়নি তা নয়। কিন্তু তোমার মত এমন ঠ্যাঁটা পিস আর একটিও দেখিনি৷ আরে বাবা, তোমায় খুন করেছি স্রেফ শিল্পের খাতিরে৷ সেলিব্রেটি খুন করে করে হেঁদিয়ে গেছিলাম।  তাঁরা স্রেফ তারকা, টাকা আর চটকের টানে শিল্পকে ত্যাগ করেছেন বহুদিন৷ বড় নিষ্প্রাণ তাঁর৷ মড়াদের কুপিয়ে কী হবে৷ অথচ গোটা শহরে মনের মত শিল্পী পাচ্ছিলাম না আমার সিরিয়াল লিস্টে জুড়ে দেওয়ার জন্য৷ 

অবশেষে খোঁজ পেলাম তোমার৷ মুগ্ধও হলাম তোমার শিল্পীসত্তার পরিচয় পেয়ে৷ আর কী আশ্চর্য,  তুমিও চাইছিলে আমার পকেট মেরে আর্টিস্টিক কেল্লা ফতে করতে৷ ব্যাস, শুরু হল  সিরিয়াল কিলার দেবু দত্ত বনাম পকেটমার রবি মাইতির লড়াই৷ বছরের পর বছর দু'জনে দু'জনকে খুঁজে কাটিয়ে দিলাম। 

কিন্তু ভায়া, যখন দেখা পেলাম; তখন কিন্তু তোমাকেই হার মানতে হয়েছিল। এক চাক্কুতে এস্পারওস্পার; রবি পকেটমার৷ ইয়ে, তুমিও বাঘের বাচ্চা বটে, চুপচাপ খতম করা যায়নি তোমায়৷  আমার ডান হাতের কবজির ওপরে ওই যে লম্বা কাটা দাগটা, ও'টা যে তোমার ব্লেডেরই দান ভাই৷ মরার আগে তোমার শেষ কামড়।

কিন্তু তারপর ভূত হয়ে আমার পিছুপিছু ঘুরে এমন হয়রান করবে, সে'টা তো আগে ভেবে দেখিনি ভাই৷ যে'খানেই যাই তুমি ঠিক পাশে এসে দাঁড়িয়ে যাও৷ মহাঝ্যামেলা৷ 

শোনো, এই আমি তোমায় আমার মানিব্যাগ তোলার সুযোগ দিলাম। আর এ চিঠি পড়ছ মানে এ'বার তো তোমার শেষ ইচ্ছেটা পূর্ণ হয়েছে৷ আর কেন ভাই৷ এ'বার এসো৷ 

ভালো থেকো।

ইতি,

দেবু দত্ত৷

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু