Skip to main content

চ্যাটার্জিবাবুর চিন্তা


- স্যার! মিস্টার চ্যাটার্জি!
- আরে! স্টোরবাবু!
- চিনতে পেরেছেন তাহলে?
- ঝারখণ্ডের ওই অজগাঁয়ে দিনের পর দিন বৌদির আশীর্বাদী মাছের ঝোল খেয়ে বেঁচে থেকেছি, সে ঋণ যে দশ জন্মেও ভোলার নয় স্টোরবাবু।
- অমন ভাবে বলবেন না স্যার। একে আপিসের বড়বাবু, তায় আমাদের পেয়িং গেস্ট। আপনার জন্য ও'টুকু করব না?
- বৌদিকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন যে সম্পর্কটা শুধু অফিসের বা পেয়িংগেস্টের ছিল না।বেনিয়মে বৌদি আমায় ধমকটমক দিতেও কসুর করতেন না।
- সে'সব বিলক্ষণ জানি।
- আমার ঘরের অবস্থা তো দেখছেন। আপনাকে যে কোথায় বসতে বলি...।
- মাদুরটা পাতাই রয়েছে তো। আমি বরং..।
- বেশ।
- আপনি চলে আসার পর গিন্নীর মনটা বড় খারাপ হয়ে গেসল। আর আপনিও এমন দুম করে গায়েব হলেন...।
- আসলে ব্যাপারটা এমনই...।
- কী এমন ব্যাপার মশাই? যার জন্যে বছর চারেক এক্কেবারে ডুব মেরে রইলেন? আর ওইভাবে কেউ গায়েব হয়? আপনার জিনিসপত্র সব এখনও আমাদের ও'খানেই পড়ে রয়েছে। গিন্নীর উপরোধে আপনার বাড়ির ফোন নাম্বারেও কম চেষ্টা করিনি। কিন্তু সে'খান থেকেও সঠিক কোনও খবর পাইনি।
- আসলে কাউকেই ঠিক...। আচ্ছা, আমি যে ভাগলপুরে স্কুলমাস্টারি করছি, সে খবর আপনাকে কে দিলে?
- নরেশ মারাণ্ডির সঙ্গে গতমাসে আপনার দেখা হয়েছিল?
- হ্যাঁ হ্যাঁ, ভাগলপুর এসেছিল কোনও কাজে। স্টেশনেই দেখা। সেই জানালে বুঝি?
- স্যার, রাগ করেননি তো? এমন ঝুপ করে চলে এলাম বলে?
- হা হা হা, কী যে বলেন! আপনি স্নান সেরে নিন, আমি বরং মুর্গি নিয়ে আসি। কষিয়ে নেওয়া যাবে। ও'বেলা আপনাকে শহর ঘুরিয়ে আনব'খন।
- মুর্গির প্ল্যান তো দিব্যি। কিন্তু আমায় বিকেলের ট্রেনে ফিরতে হবে।
- যা হোক। আপনি জিরিয়ে নিন। আমি বাজার ঘুরে আসি।
- চ্যাটার্জিবাবু। আমি আপনার বয়োজ্যেষ্ঠ,  শুভাকাঙ্ক্ষী। অমন বড় চাকরী ছেড়েছুড়ে এ'খানে...এমন অবস্থায়...কেন?
- একলা মানুষ। যখন যেমন।
- পিড়াপিড়ি করতে আসিনি। আপনি যে সুস্থ আছেন, সে'টা জানলে গিন্নী সোয়াস্তি পাবে। আমার আসার মূল উদ্দেশ্যটা আগে জানাই। আপনি চলে আসার কিছুদিন পর আপনার এক পরিচিতা আপনার খোঁজে আসেন। আপনাকে না পেয়ে অত্যন্ত বিহ্বল হয়ে পড়েন। এই চিঠিটা উনি আপনার জন্য রেখে যান, এ'টা নাকি অত্যন্ত জরুরী।
- আচ্ছা।
- চিঠিটা টেবিলের ওপর রইল?
- বেশ। গামছা রইলো স্টোরবাবু। আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি চট করে বাজার থেকে ঘুরে আসছি।

**

মাঝরাতে ট্রেনের হুইসল স্পষ্ট শোনা যায়। স্টোভে সসপ্যান চাপালে একটা অদ্ভুত স্বস্তি নেমে আসে, সে'টা ভালো লাগে চ্যাটার্জিবাবুর। দক্ষিণের জানালা দিয়ে ভেসে আসা বাতাসে কয়লার ধোঁয়ার গন্ধ। মোড়ের মাথায় বেজে চলা ঢোলের শব্দ আর দেহাতি সুরে আপন মনেই মাথা নেড়ে চলেন তিনি। বড্ড গরম পড়েছে,  একটু বৃষ্টি না নামলে ভ্যাপসা ভাবটা যাবে না।

গঙ্গার ঘাটের কথা মনে পড়ে চ্যাটার্জিবাবুর। ছোটবেলার পাড়া। ধুনো,ঘাস, ছোলাচানাচুরওলার ঠেলার লম্ফের গন্ধ মেশানো সন্ধ্যেগুলো। ক্রমাগত ক্রসব্যাট চালানোর জন্য সাহেবদার কানমলা। ক্লাবঘর থেকে ভেসে আসা একটানা ক্যারমের খটাখট। টিউশনির ব্যাগ পিঠে সাইকেল প্যাডেলের মচরমচর।

আর গঙ্গার ঘাট ঘেঁষা সেই নিমগাছটা। ছায়া আর শেষবিকেল মিলে যে'খানে এক খাবলা বুকছ্যাঁত পড়ে রইত প্রত্যেক সন্ধ্যেয়।

- আমরা বিয়ে করব, তাই না?
- ইডিয়ট।
- জাস্ট। রিকনফার্ম করছিলাম।
- ডাম্ব ট্যূ।
- কবে...মানে..ঠিক...মানে কী'ভাবে?
- তোর দ্বারা হবে না বাবু। আমিই বলব। কখন। কী'ভাবে।
- আমার দ্বারা কেন হবে না? দিব্যি হবে।
- আগে অনার্সটা না ধেড়িয়ে ম্যানেজ কর। ও'সব ডেঁপোমি পরে হবে।
- যদি...।
- যদি কী?
- যদি না হয়?
- সাধে বলি? ইডিয়ট? ডাম্ব?
- ছোটমামা বলে তুই আজহারউদ্দীনের কব্জির মোচড় হলে আমি উকুন বাছার আঙুল।
- শোন, যে'দিন সময় হবে সে'দিন দেখবি তোর ঘাড়ে চেপে বসে চিৎকার করে বলছি "এসে গেছি বাবু"! সে'দিন তোর কত কাজ। নতুন বাসনপত্র,  নতুন পর্দা, ছোট পোর্টেবল টিভি,কত কী কেনার।
- কী'সব যে বলিস।
- ঘাবড়াস না। ঘাড়ে চাপার কথাটা ফিগারেটিভ। চিঠি দিয়ে জানাবো। তখন আবার ধানাইপানাই করিস না।

**

স্টোরবাবু চিঠিখানা পড়ার টেবিলে রেখে গেছেন আজ মাস চারেক হলো। এনভেলপ খোলার সাহস এখনও হয়নি। রাতের চা খাওয়াটা বেড়েছে।
চিঠিতে ও কী লিখেছে? "সরি বাবু, খবরটা ঠিকই শুনেছিস" নাকি "এসে গেছি বাবু"?
ট্রেনের হুইসেলে বারবার বাড়াবাড়ি ভাবে চমকে ওঠাটা চ্যাটার্জীবাবুর এক বিশ্রী বদঅভ্যাস।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

ব্লগ-বাজ

আর চিন্তা নেই । বাঙালিকে আর রোখা যাবে না । আর সামান্য (সম্ভবত কিঞ্চিত গোলমেলে ) কবিতা ছাপাবার জন্যে সম্পাদক কে তোল্লাই দিতে হবে না । আর প্রেমে লটরপটর হয়ে ডায়েরি লিখে প্রাণপাত করতে হবে না। পলিটিক্স কে পাবলিক-জন্ডিস বলে গাল দেওয়ার জন্য আর “প্রিয় সম্পাদক” বলে আনন্দবাজারের ঠ্যাং ধরতে হবে না। কেন ?  হোয়াই? বাঙালি ব্লগিং শিখে গ্যাছে যে। ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে শাণিত তলোয়ারের মত “ পোস্ট”-সমূহ জনতার ইন্টেলেক্ট এসপার-ওসপার করে দেবে ; হাতে-গরম গায়ে-কাঁটা। বাঙালি মননের নব্য জিস্পট ; ব্লগ-স্পট । কে বলে যে বাঙালি ব্রিগেডে বুক্তুনি দিয়ে আর ফুটবল মাঠে খেউড় করে খতম হয়ে গ্যাছে ? কে বলে যে বাঙালির ঘিলু কফি হাউসে ভাত ঘুমে মগ্ন ? বাঙালিকে একবার ব্লগখোর হতে দিন , সমস্ত অভিযোগ ভ্যানিশ হয়ে যাবে । পোপ থেকে পরশুরাম ; ডেঙ্গু থেকে মশাগ্রাম ; বং-ব্লগের দাপট রইবে সর্বত্র । বাঙালির সমস্ত আশা-ভরসা-জিজ্ঞাসা এইবারে ব্লগ মারফত্‍ পৌছে যাবে ট্যাংরা ট্যু টেক্সাস । তোপসে মাছের স্প্যানিশ ঝোলের রেসিপি কী ? বাঙাল-ঘটি মিল মহব্বত-হয়ে গেলে কি বাঙ্গালিয়ানা চটকে যাবে ? নেতাজী কি এখ

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু