Skip to main content

পাসেং ও পিতা

মঠের ভাঙা দেওয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন বৃদ্ধ। বয়সের হিসেব তাঁর দাড়ির কালোর মত হারিয়ে গেছে। হাড় জিরজিরে, চামড়া ঝুলে পড়েছে। উত্তুরে কনকন হাওয়ায় ধবধবে লম্বা চুল এলোমেলো ছড়িয়ে পড়ছে তাঁর গোটা মুখে। উজ্জ্বল সাদা আলখাল্লায় বৃদ্ধটি মেঘ কালো আকাশের গায়ে চকের দাগ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল যেন।
কে বলবে এখন দুপুর, চারপাশ সবজে-অন্ধকারে থমথমে।

বৃদ্ধ শীতে কাঁপছিলেন একটানা। কিন্তু আকাশের কালো থেকে কিছুতেই চোখ সরতে চাইছিল না। একটা কান ফাটানো গুড়গুড় শব্দে মাটি কেঁপে উঠল। বৃদ্ধ কয়েক মুহূর্তের জন্য চোখ বুজে ফের তাকালেন আকাশের দিকে। আবার কোনও দেওয়াল ধসে পড়ল বোধ হয়। বা মঠের কোনও ঘর।

"বাবা" ডাকে বৃদ্ধ এবারে ঘুরে তাকালেন। পাসেং। তাঁর আদরের পাসেং। উচ্ছ্বল যুবক পাসেং। উজ্জ্বল চক্ষু পাসেং। আড়াই মাস বয়েসের যে রুগ্ন শিশুকে মঠের দুয়ারে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন তিনি, তার সাথে এ অগ্নিপুত্রের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

- তুমি এসেছ? যাক্‌।
- আজ যে আসতেই হত বাবা।
- হ্যাঁ। আজ তো আসতেই হত।
- এ সমস্তই তো আপনার জানা ছিল, তাই না?
- সমস্ত। এমনকি এই আকাশের এমন রঙও আমার কাছে অচেনা নয়।
- এখনই সমস্ত শেষ?
- আর কয়েক মুহূর্ত। আর সামান্য একটা কাজ।
- আপনি বলেছিলেন আশা আছে।
- আশা খুঁজছ কেন পাসেং? বাঁচার লোভ? এ নোংরা পৃথিবী আঁকড়ে থাকার লিপ্সা?
- আমি লোভী নই বাবা। আপনি আমায় সে'ভাবে মানুষ করেননি।
- তবে?
- মিসুং।
- মিসুং। তোমার পুত্র। আহ্‌। বড় মায়া ওর চোখে।
- মিসুং তো কোনও দোষ করেনি বাবা।
- দোষ? এর আগে যত শিশু মারা গেছে আমাদের পাপে, তাদের কোনও দোষ ছিল পাসেং? কিন্তু তাদের মরতে হয়েছে।
- দৈব।
- দৈব? বটে।
- শিশুহত্যার দায় জমতে জমতে যেদিন উপচে পড়বে, সেদিন পৃথিবী নষ্ট হবে। আকাশে তিনি বসে গুনে চলেছেন। প্রতি নিয়ত। শিশুর রক্ত উপচে গড়িয়ে গেলে পৃথিবীকে ভেঙ্গেচুরে নতুন ভাবে গড়বেন তিনি। যেমন এর আগেও হয়েছে। হাজার হাজার বার।
- তাহলে এবারেই বা ব্যতিক্রম হবে কেন পাসেং?
- পৃথিবী ধ্বংসই যদি হয়, তাহলে কোথায় আমি আর কোথায় মিসুং। নিজের ছেলের বেঁচে থাকার অধিকারের জন্য লড়ব না বাবা?
- তুমিও থাকবে না যদি পৃথিবী ধ্বংস হয়। আমি বাবা নই? আমার দুঃখ হবে না?
- পৃথিবীকে বাঁচান তাহলে। ঈশ্বরের পুত্র আপনি বাবা। ঈশ্বরের এ অন্যায় বরদাস্ত করবেন কেন?
- ঈশ্বর অন্যায় করেন না পাসেং। সে'টা মানুষের কাজ। তিনি শুধু মানুষের পাপের হিসেব রাখেন। শিশুহত্যার পাপ। সংখ্যা পূর্ণ হয়েছে, পাপের ঘড়া উপচে পড়তে আর মাত্র একটা শিশুহত্যা দরকার।
- বন্ধ করুন। পৃথিবীটাকে থাকতে দিন। এই হাওয়া, মাটি, পাহাড়; আমার মিসুংকে অকালে হারাতে দেবেন না বাবা।
- মিসুং আমার সাথে থাকে পাসেং। ওকে আমি তোমার চেয়ে কম ভালোবাসিনা। ওর অধ্যয়ন আমার সাথে, আমার সাথে ও আহারাদি গ্রহণ করে। আমরা দৈনিক একসাথে সূর্যোদয় দেখি। কিন্তু এ পৃথিবীর সময় শেষ। আমাদের চারদিকে পাহাড় ভেঙ্গে পড়া শুরু হয়ে গেছে পাসেং। নদীর জল আগুন রাঙা হয়ে ধোঁয়াময় হয়ে উঠছে। বাতাসে মিশছে বিষ। এ মঠ ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য, তাই এর দেওয়াল ভেঙ্গে পড়া শেষ হয় সবার শেষে। পিছনের ধ্বংসাবশেষের দিকে তাকাও, তবে বুঝবে যে বিনাশকাল এসে পড়েছে। সবার শেষে ভেঙ্গে পড়বে মঠের মূল মন্দিরের ওই চুড়ো, আকাশ জ্বালানো এক বিদ্যুৎ শিখা এসে তাঁকে ধূলিসাৎ করবে। আর তার জন্য দরকার আর একটি শিশুর মৃত্যু। তারপর সমস্ত শেষ। সমস্ত কিছুর ধুলোয় মিশে যাওয়া। প্রতি পঞ্চাশ হাজার বছর অন্তর আমি এমন ভাবে একা হয়ে যাই পাসেং। বড় বেদনার সে একাকীত্ব। আবার ছেনি হাতুড়ি নিয়ে আমি মঠ গড়তে শুরু করব, আর ঈশ্বর ফের বসবেন পৃথিবীতে পাহাড়, নদী, বর্ষা তৈরি করতে। আবার নতুন করে মানুষ। আবার সভ্যতা। আবার অসভ্যতা। শিশুহত্যা। পাসেং। এ অমোঘ, এ অবিচল।
- এ ধ্বংস আটকানোর কোনও উপায় নেই?
- উপায়? আছে। নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সে উপায় তোমায় বলাটা আমার উচিৎ নয়। তবু। বলব। কারণ জানো? হাজার হাজার পৃথিবী পেরিয়ে এসেও পিতৃ-স্নেহ কোনোদিন অনুভূত হয়নি এর আগে। পাসেং। আমার খোকা তুমি, আদরের, স্নেহের।
- উপায় কী বাবা?
- মঠের সব ছেলেমেয়েরা চলে গেছে। রয়ে গেছে শুধু মিসুং। তোমার অপেক্ষায় রয়েছে সে।
- উপায় কী?
- দু'টো খুন।
- বাবা!
- দু'টো খুন পাসেং। তোমায় মিসুং আর আমাকে হত্যা করতে হবে। শিশু হত্যার পাপ উপচে পড়ার পর আমি বধযোগ্য হই যতক্ষণ না নতুন পৃথিবী গড়ে উঠছে। আর নতুন পৃথিবী গড়ে ওঠার আগে যদি আমায় খুন করা যায় তবে এ ভাঙ্গাচোরা পৃথিবী সম্পূর্ণ ধ্বংস হবে না। সে'টাই নিয়ম। তুমি আর যে দু'চারজন বেঁচে থাকবে সেই বিষাক্ত পৃথিবীতে, সবাই মিলে ঠিক পারবে ঘুরে দাঁড়াতে। নিশ্চিত। মিসুং না থাকলেও তুমি থাকবে সে’খানে। সে পৃথিবীতে সুবাতাস ফিরে আসবে। নতুন পৃথিবী নির্মাণের প্রয়োজন পড়বে না। কিন্তু তার জন্য তোমায় আগে মিসুংকে খুন করতে হবে, তারপর আমায়।
- কী বলছেন বাবা!
- বাবা রে, তুই আমার চোখের মণি। মারা যাসনে পাসেং। বাঁচ। এ দুনিয়াটাকে বাঁচার একটা সুযোগ দে। বের কর ছুরিটা...আর আমাদের...।
- পিতৃস্নেহে অন্ধ হয়ে আপনি আমায় বলছেন আমার পুত্র আর পিতাকে খুন করতে?

**

পাসেংয়ের নিথর দেহটা রক্তে ভেসে যাচ্ছিল, ওর বুকে বসানো ছুরিটার দিকে বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলেন বৃদ্ধ।
বাবা। বাবার পাঁজর যে কতটা যন্ত্রণা বহন করতে পারে তা আঁচ করতে পারছিলেন। মনে হচ্ছিল বুকের মাংস আগুনে কাটছে, গোটা গায়ে কেউ বিঁধিয়ে দিচ্ছে বিষ মাখানো ছুঁচের ডগা। বৃদ্ধের সাদা আলখাল্লা রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। চোখের জল মুছে তিনি উঠে দাঁড়ালেন।


মুঠো শক্ত করলেন তিনি।
অস্ফুটে বলে উঠলেন "আমিও ঈশ্বরের বরপুত্র। যার দুনিয়ায় পিতাদের এত যন্ত্রণা, তাঁর নিয়মে নিজের আত্মাকে কোটি কোটি বছর ধরে যন্ত্রণাবিদ্ধ করার কী মানে? সন্তানের দুঃখে পাসেং আত্মহত্যা করল, আহ সে যে কী যন্ত্রণা। সে যন্ত্রণার আগুন ঈশ্বরকে স্পর্শ করবে না, তা কী করে মানা যায়?"
জোব্বার ফোঁদলে রাখা ছেনি হাতুড়ি বের করে খাদে ছুঁড়ে ফেলে খোকার বুক বসানো ছুরিটা বের করে নিলেন বৃদ্ধ।


"খোকা ক্ষমা করিস। মিসুং, ক্ষমা করিস। কিন্তু এ পৃথিবীকে রেখে যেতে হবে। সমস্ত পিতার জন্য যন্ত্রণা রেখে যেতে হবে। হবেই। আর আমার পিতাও যে যন্ত্রণার বাইরে থাকবেন না।", বিড়বিড় শেষ হলে মিসুংয়ের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন বৃদ্ধ।

**

পৃথিবীর ভাংচুরের শব্দ বেশ আসছিল। খাতা কলম নিয়ে আরামকেদারায় সবে গা এলিয়ে দিয়েছিলেন ঈশ্বর। কত হিসেব কষতে হবে, কত অঙ্ক। কিন্তু আচমকা ভাংচুরের শব্দ ঠাণ্ডা হয়ে গেল। আর তখনই একটা বিকট যন্ত্রণা বুকে বিঁধল, মনে হল যেন বুকের মাংস আগুনে কাটছে, যেন গোটা গায়ে কেউ বিঁধিয়ে দিচ্ছে বিষ মাখানো ছুঁচের ডগা।

"খোকা ঠিক আছে তো? বোধিসত্ত্বের কোনও ক্ষতি হয়নি তো?", ককিয়ে উঠলেন ঈশ্বর।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু