Skip to main content

সোধি সাহাব

উত্তর বিহারের প্রত্যন্ত অঞ্চল, মাইল দুয়েকের মধ্যে কোনো বসতি নেই। অনতিদূরে কোশী নদীর মেজাজ মাঝেমধ্যেই বেয়াড়া হয়ে পড়লেও, গ্রীষ্মকালে এ অঞ্চল বড় রুক্ষ। মে মাসের দুপুরে রোদের দাপটে পথ চলা দুষ্কর,  আর মাঝে মধ্যেই গরম হাওয়ার ঝাপটায় উড়ে আসে ধুলো। ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে মাঝেমধ্যে দু'একটা সাইকেলআরোহী বা পথচারী দেখা যায়, তাদের সকলের নাকেমুখেই গামছা প্যাঁচানো। রাতের দিকে অবশ্য তাপ গলানো ফুরফুরে হাওয়া বয়।

সে'খানে চলছিল রাস্তা তৈরির কাজ, ন্যাশনাল হাইওয়ে। বড় একটা কন্সট্রাকশন কোম্পানির ক্যাম্প সে'খানে। ক্যাম্পে অফিসঘর,  গুদামঘর ছাড়াও রয়েছে কর্মচারীদের জন্য থাকার জায়গা, মেসঘর আর খানকয়েক গেস্টরুম। আশেপাশে রুক্ষতার মধ্যে ক্যাম্পের ভিতরের পরিপাটি পরিবেশ যেমন বেমানান, তেমনই আরামদায়ক। আমাদের কোম্পানি সে'খানে ফার্নেস অয়েল, ডিজেল আর বিটুমেন সাপ্লাই দিত, সে সুবাদে যাতায়ত লেগেই থাকত। গেস্টরুমগুলো বাতানুকূল,  ছিমছাম; থাকতে কোনো অসুবিধেই ছিল না। তাছাড়া মেসের বিহারী ঠাকুর উমেশচন্দ্রের রান্নার হাতও ছিল সরেস।

সূপল জেলার এক জনহীন প্রান্তে তৈরি সেই কন্সট্রাকশন কোম্পানির ক্যাম্পের মধ্যমণি ছিলেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসার 'সোধি সাহাব'।

ক্যাম্পের যাবতীয় দেখভাল ছিল সোধিবাবুর দায়িত্বে আর তাঁর দাপটে পান থেকে চুন খসবার উপায় ছিল না। পঞ্জাবের এই সুপুরুষ মানুষটির  শখ বলতে সকালে নিজের হাতে ঘণ্টা তিনেক ক্যাম্পের বাগান পরিচর্যা আর সন্ধের তিন পেগ স্কচ।

সোধিবাবুর স্কচ মেশানো গল্পে বিহারের কয়েকটা সন্ধে বড় মনোরম হয়ে উঠেছিল। মাঝেমধ্যেই আর্মি ডিসিপ্লিন আর উমশচন্দ্রের পেঁয়াজ-মির্চির পকোড়ার প্রশংসা করতেন দরাজ কণ্ঠে। রাজনীতির বিশেষ ধার ধারতেন না, তাছাড়া সমস্ত ব্যাপারে গল্প ফেঁদে বসতে পারতেন তিনি।

ভদ্রলোকের তিন নম্বর পেগের শেষে ঈষৎ ঝিমিয়ে পড়তেন, তবে গল্প থামত না। সে সময়টা বিড়বিড় করে একাই বকে চলতেন, উত্তরের ধার ধারতেন না। আমি মন দিয়ে শুনতাম। প্রবীণ ভদ্রলোক বড় ভালো মানুষ; অত খোলামেলা আড্ডাতেও কোনোদিনও কখনও তাঁকে পরনিন্দা করতে শুনিনি। ভদ্রলোকের মধ্যে ঈর্ষার ছিঁটেফোটা আছে বলেও মনে হয়নি কখনো।
প্রবল আড্ডাবাজ, অথচ কোনোদিন ওর গল্পে 'গসিপ' খুঁজে পাইনি।

তিন পেগের শেষে ভদ্রলোকের বিড়বিড়ে একদিন জানতে পেরেছিলাম আশফাকের কথা। আশফাকের লাশ দেখেছিলেন সোধি সাহেব। ক্ষতবিক্ষত,  রক্তে মাখামাখি। অন্য অনেক লাশের পাশে পড়ে। দেখে স্বস্তির শ্বাসও ফেলেছিলেন, শত্রু সৈন্য বলে কথা। এমন বহু লাশ দেখেছেন ভদ্রলোক, না দেখে উপায় কী? এদের আটকাতে না পারলে নিজেদের লাশ হয়ে পড়ে থাকতে হত।

আশফাকের পিঠের ব্যাগের বিভিন্ন কাগজপত্র হাতড়ে ওর জন্মদিন জানতে পেরেছিলেন। সোধি সাহেবের ছেলে সোনুর জন্মও ওই একই দিনে, একই বছরে। ছ'বছর বয়সে আচমকা ম্যালেঞ্জাইটিসে মারা না গেলে  সোনুও এমনই গাঁট্টাগোঁট্টা জওয়ান হত। সোধি কেঁপে ওঠেননি, দায়িত্বে নড়বড়ে হয়ে পড়েননি এক মহূর্তের জন্যও। শুধু সোনুর ছবির সঙ্গে তাঁর মানিব্যাগে চিরকালের জন্য ঠাঁই পেয়েছিল আশফাকের আই-কার্ডের সাদাকালো ছবি।

'ইউ নো মুকর্জি, কমিট ইওরসেল্ফ টু প্রিন্সিপাল, নেভার আন্ডারপারফর্ম ইন ইওর ডিউটিস; বাট নেভার সাকাম্ব টু ইন্ডিভিজুয়াল হ্যাট্রেড। অ্যান্ড ট্রাই নট টু বার্ন ব্রিজেস'।

সেই একবারই ভদ্রলোককে চতুর্থ পেগের আশ্রয় নিতে দেখেছিলাম।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু