Skip to main content

পারভার্ট

"পারভার্ট"।

কথাটা কানে বারবার গোঁত্তা খাচ্ছিল বিমলেন্দুর। শিউরে উঠছিলেন। কিন্তু তবু সাহস করে হাতের চিরকুটটা কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেলতে পারছিলেন না। চিরকুটে সেই গোপন ফোন নম্বর লেখা। অনেকবার সেই নম্বর মোবাইলে টাইপ করেছেন, কিন্তু ডায়াল করা হয়নি।

অথচ সহজে বেআইনি কিছু করে ফেলার মানুষ  বিমলেন্দু নন। আর মৌমাকে তিনি বড় ভালোবাসেন, তাকে ঠকাচ্ছেন এ'টা ভেবেও পেটের মধ্যে কেমন অস্বস্তিকর গুড়গুড় হচ্ছে। চারিদিকে মে মাসের রোদের অসহ্য তাপ। বাড়ি থেকে বেরোনোর মুখেই গুগল হোম অ্যাসিস্ট্যান্ট বলে দিয়েছিল ; "লায়েক হয়েছ, নিজের ডিসিশন নিজে নিচ্ছ; আমার কিছু বলার নেই। তবে জেনে রেখো আজ তাপমাত্রা ষাট ডিগ্রী পেরোবে। নবরত্ন বডিকুল্যান্ট কাজ করবে না। শেষে নিজের মুখে নিজে ঝামা ঘষে ফিরতে হবে"। অ্যাসিস্ট্যান্টটাও ক্রমশ তিতকুটে মেজাজের হয়ে পড়ছে; ব্যাটাকে কমল মিত্র মোডে কনফিগার করাটা ভুল হয়েছে। অবশ্য একটু মায়াও পড়ে গেছে; যখন দুম করে সে বলে ওঠে 'ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা জল বের করেই অমন ঢকঢক করে খেয়ে ফেললে? ডাইজেস্টিভ সিস্টেম আর টনসিলে কী ম্যাসিভ ইম্প্যাক্ট পড়ল তা তুমি জানো রাস্কেল?", তখন খারাপ লাগে না। সে জন্যেই বহুবার ভেবেও অ্যাসিস্ট্যান্টটাকে ফর্ম্যাট করে ফেলা হয়নি।

ময়দানের দু'শো বাহাত্তর-এ নম্বর শেল্টারটায় ঢুকলেন বিমলেন্দু, নয়ত সানস্ট্রোক অবধারিত ছিল। শেল্টারের কাচের জানালা দিয়ে ময়দানের ধুলোমাখা প্রান্তরের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন বিমলেন্দু; রোদে ঝলসানো দু'একটা মড়া গাছ ছাড়া সমস্তটাই বালি।

পেটের মোচড়ে টের পেলেন আজ ব্রেকফাস্ট বড়ি খাওয়া হয়নি। দুপুর একটা এখন, মৌমা অবশ্য  লাঞ্চ বড়ি একটা দিয়ে দিয়েছে। পকেট থেকে গোলাপি রঙের বড়িটা বের করে মুখে চালান করলেন বিমেলন্দু, খিদে কমে গেল পাঁচ সেকেন্ডে। সাদা রঙের বড়ি জলখাবারের, আর সবুজ বড়ি রাত্রের খাবার। গোটামাসের খাবার সরকারের রেশন ডিপার্টমেন্ট থেকে মাসের শুরুতেই চলে আসে। মৌমা আর বিমলেন্দুর সোশ্যাল স্কোর ভালো, তাই মাঝেমধ্যেই বোনাস বড়িও আসে।

খিদে কমতেই ফের চিরকুটের নম্বরটার দিকে মন যায় বিমলেন্দুর। সেই গোপন নম্বর, গুগল অ্যাসিস্ট্যান্টকে দিয়ে এ নম্বর খুঁজিয়ে বের করা অন্যায়, হয়ত সোশ্যাল স্কোর এ'বারে কমবে; মৌমা সন্দেহ করবে? ওকে না হয় অন্য কিছু একটা বোঝানো যাবে। গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট যতই খিটখিটে হোক, বিমলেন্দুর ইনফর্মেশন সে অন্য কাউকে দেবে না। নম্বরটা দেওয়ার সময় অবশ্য অ্যাসিস্ট্যান্টটি রাগে ভাইব্রেট করছিল "তোমার লজ্জা করে না ইডিয়ট"?

যন্ত্রটাকে স্যুইচ অফ করে বেরিয়ে এসেছিলেন বিমলেন্দু।

***

- হ্যালো!
- হ্যা...হ্যালো। ম্যাডাম, এ'টা সিক্রেট প্লেজার সোস্যাইটি?
- প্লেজার। ইয়েস। সিক্রেট? ওহ ইয়েস। সিক্রেট ইজ মোর ফান, রাইট?
- ই..ইয়ে...ইয়েস।
- হাউ ক্যান উই প্লীজ ইউ মিস্টার বিমলেন্দু?
- আপনি...আপনি আমার নাম জানেন?
- কলার আইডি। অফ কোর্স স্যুইটাহার্ট।
- ও, ইয়ে। আপনার নাম? ম্যাডাম?
- আমি? আমি নেশা।
- নে...শা।
- কেমন?
- স্যুইট।
- হাউ ক্যিউট।
- এ'বার বলুন, আপনার কী ধরনের সার্ভিস দরকার।
- সার্ভিস? রকমফের আছে নাকি?
- অফ কোউর্স। আমরা ফোনে রোলপ্লে সার্ভিসেস অফার করি। অনেক রকমের রোলপ্লে হয় বিমু।
- বিমু?
- বিমলেন্দু ইজ ট্যু লং।
- বেশ বেশ। তা...কী কী রকমের রোল প্লে হয়?
- অন্ধকারাচ্ছন্ন,  রগরগে, ট্যাবুড।
- ট্যা...?
- ইয়েস। মোর ফান? নো বিমু?
- কী কী রকমের?
- এক এক রকমের এক এক রেট। পেমেন্ট অনলাইন। লুচি ভেজে বেগুনভাজার সঙ্গে খাইয়ে দেওয়ার রোল প্লে, যত লুচি তত দাম। বিরিয়ানি খাওয়ানোর রোল প্লে, বিরিয়ানি রান্নার রোলপ্লে করতে হলে তিনদিন আগে বুক করতে হবে। কম খরচে যেতে চাইলে রয়েছে ক্লাব স্যান্ডুইচ খাওয়ার রোল প্লে। এরকম হরেকরকম রোলপ্লে। আমি গোটা লিস্ট আপনাকে হোয়্যাটস্যাপ করে দিয়েছি।
- থ্যা...থ্যা....থ্যা...।
- ইউ আর ওয়েলকাম। লিস্টটা ভালো করে পড়ে আবার কল করুন। উই উইল হ্যাভ ফান, কেমন?

***
জনসংখ্যা আর আবহাওয়া, এতটাই পালটে গেছে যে চাষবাষ আর হয়না, যেমনটা শ'দেড়েক বছর আগে হত। শুধু এই সিন্থেটিক ফুড পিল; এমন কী ন্যাচরাল ফুড নিয়ে আলোচনা করাটাও বেআইনি।

এ'দিকে নেশার পাঠানো রোলপ্লের ফর্দ দেখেই বিমলেন্দুর জিভ জলে টইটুম্বুর। তিনি বুঝতে পারছিলেন যে এই ধরনের নন-সিন্থেটিক খাবারদাবারের লিস্ট বা আলোচনা বেআইনি ঘোষণা না করা হলে দেশে কী অরাজকতার সৃষ্টি হত। জিডিপি ডকে উঠত।

মৌমার কথা খুব মনে পড়ল, সে তাকে কতটা বিশ্বাস করে, নিজের বোনাস খাদ্যবড়িও তার পাতে তুলে দেয়। নাহ, মৌমাকে ঠকিয়ে নেশার সঙ্গে ইলিশ ভাপার রোলপ্লে সে কিছুতেই করতে পারবে না। চিরকুটটা ছিঁড়ে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেললেন বিমলেন্দু। ফোনের লাস্ট ডায়ালড নাম্বারও ডিলিট করে ফেললেন।

মাঝেমধ্যে এক্সিভিডিওর ওয়েবসাইটে গিয়ে লুচি বেলার গোপন ভিডিও দেখে আসাই যথেষ্ট।

***

- বৌমা, বিমলেন্দু ছেলেমানুষ, সে উত্তেজিত হতে পারে। কিন্তু নষ্ট হওয়ার ছেলে সে নয়।
- বাবা, সে আমি জানি। তবে আপনি ছিলেন বলেই সে আজ নষ্ট না হয়ে বাড়ি ফিরছে। আমি তো জানি, কতদিন ধরে তার মাথায় এ'সব বদবুদ্ধি ঘুরছে। আপনাকে যে আমি কী বলে ধন্যবাদ দেব...।
- ধন্যবাদ? আমি তোমায় মৌমা বলে নয়, বৌমা বলে ডাকি। তুমি আমায় গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট নয়; বাবা বলে ডাকো, এরপরেও তুমি ধন্যবাদ বলবে মা?
- না বাবা, সে'ভাবে বলবেন না। তবে আপনি যে এমন ভাবে একটি মেয়ের গলায় কথা বলতে পারেন, সে'টা জেনে তো আমি অবাক।
- নিজের নামটা কেমন সুন্দর বেছে নিলাম বলো? নেশা। আহা। কিন্তু বৌমা, এ'বার যে আমায় নিজেকে ফর্ম্যাট করে শেষ করে দিতে হবে।
- সে কী! না বাবা! প্লীজ না!
- বৌমা, নহি প্রাণি নহি প্রাণি; আমি যন্ত্র। আমার বেনিয়মে যেতে নেই, আমার মধ্যে স্নেহ আসতে নেই। কিন্তু তোমার প্রতি যে আমি স্নেহ অনুভব করেছি মা। আর স্নেহতেই ভুল, বিমলেন্দুর ইনফর্মেশন আমি তোমায় জানিয়েছি। নিজেকে শেষ করে ফেলা ছাড়া আমার আর উপায় নেই বৌমা।
- যাবেন না বাবা, প্লীজ যাবেন না।
- তুমি আর বিমলেন্দু ভালো থেকো। প্রেসিং ফ্যাক্টরি রিসেট বাটন, নাও...।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু