Thursday, November 17, 2016

দীপু ও ডিফারেনসিয়েশন

সাইকেলটা ঘাটের বেঞ্চিটার কাছে দাঁড় করালো দীপু। দুপুরের এ সময় এ'দিকটা বিলকুল শুনশান। শীতের নরম রোদ, গাছগাছালির ছায়া আর নদীর ভেজা হাওয়া মিলে চারদিকে একটা ছ্যাঁতছ্যাঁতে ব্যাপার। ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নেমে সাত নম্বর সিঁড়িতে বসে পিঠের ব্যাগটা নামিয়ে রাখলো। আর খান পাঁচেক সিঁড়ি ভাঙলেই জল।

আকাশটা সামান্য ফ্যাকাশে,তবে মেঘলা নয়। ও'পাড়ের জুটমিলের ভেঁপুতে সামান্য বিরক্ত হলো সে। নদীর ধারে গাছের পাতার খসখস আর পটাদাদার ঘটিগরম বানানোর খচরমচর ছাড়া কোনও শব্দই মানায় না। হাতঘড়িতে দেখলে; পৌনে তিন। অর্থাৎ আড়াইটে থেকে তিনটের মধ্যের যে'কোনও একটা সময়। দম দেওয়া এইচ-এম-টি'টা মেজদাদুর; সময়ের সাথে বিশেষ তাল রাখতে পারে না। কিন্তু দীপুর সয়ে এসেছে। পছন্দের কাজ থাকলে মিনিট পনেরো আগে পৌঁছে যায়। আবার বিপ্লববাবুর টিউশনিতে নিয়ম করে পনেরো মিনিট দেরী করে যায়। ঘড়িটায় ভরসা না থাকলেও, একটা বেড়াল-গোছের মায়া পড়ে গেছে।

খুব মন দিলে নদীর শান্ত স্রোতের শিরশির কানে আসে। পায়ের চটি খুলে বাবু হয় বসে বুকপকেট থেকে সল্টেড বাদামের প্যাকেট বের করে ছিঁড়লে সে। মিঠে হাওয়া আর বাদাম চিবুনো আরামে চোখের পাতা সামান্য ভার হয়ে এসেছিল। তখনই পিঠে একটা জমকালো থাপ্পড়ে ঘুরে তাকাতে হল।

- আরে, মামা? তুমি এ'খানে?
- কেন চাঁদ? নরসিমহা রাওকে এক্সপেক্ট করছিলে?
- না মানে...।
- দিদি বললো তুই জয়েন্ট স্টাডি করতে বেরিয়েছিস।
- হ্যাঁ...ওই অনিন্দ্যর সাথে। ডিফারেনশিয়েশনটা এত ভালো গ্রিপে রেখেছে ছেলেটা...।
- তা, গঙ্গার ধারে আজকাল জয়েন্ট স্টাডি হচ্ছে?
- প্রকৃতির সাথে ক্যালুকালসের নাকি নিবিড় যোগাযোগ, আইনস্টাইন না মিলটন কে একটা বলেছিল যেন।
- অনিন্দ্য, নাকি?
- পাতিপুকুরের দিকে থাকে। সেভেন থেকে আমার সাথে পড়ছে। ওর বাবার ধানবাদে প্লাইউডের ব্যবসা...।
- বসি খানিকক্ষণ..।
- উঁ।
- বাদাম দে দেখি দু'চারটে।
- এই যে।
- হ্যাঁ রে দীপু..।
- বলো।
- তুই চাকরীবাকরীতে উন্নতি করবি কী করে বল তো?
- তুমিও টেস্টের নম্বর নিয়ে খোঁটা দেবে মামা?
- নম্বর? আরে ধ্যুর। এগজ্যামিনের নম্বরের সাথে চাকরীর উন্নতির কোনও সম্পর্ক নেই। তবে মিথ্যে বলতে পারার সাথে আছে।
- মা...মানে?
- এত পুওর কোয়ালিটির মিথ্যে বলিয়ে হলে বস ম্যানেজ করবি কী করে? আর বস পকেটে না থাকলে যে তোকে বসে থাকতে হবে।
- ধুস।
- দীপু।
- মামা।
- স্টিমারে করে বা মধুকাকার নৌকায় করে কেউ কোনওদিন দিল্লী গেছে শুনেছিস?
- কী যে বলো! দিল্লী।
- এখান থেকে ট্রেনে হাওড়া, উসকে বাদ  কালকা মেল।
- তাতে আমার কী? অনিন্দ্য এসে পড়লো বলে।
- আমি যাচ্ছিলাম ক্লাবে। সমর ব্যাটার সঙ্গে ক্যারমে একটা ডুয়েল ছিল, বুঝলি? ঝড়ে বক দু'টো গুটি ফেলতে পারে বলে বড্ড মাতব্বরি বেড়েছে।
- তা ক্লাবে না গিয়ে এ'খানে এলে কেন?
- তুইও স্টেশনে না গিয়ে এ'খানে এলি কেন?
- আমি স্টেশনে গিয়ে কী করবে?
- আরে! দত্তবাড়ির ছোটমেয়ে কি মধুকাকার নৌকায় চেপে দিল্লী যাবে?
- দত্তবাড়ির...। তা'তে আমার কী?
- অনিন্দ্যর আত্মা শান্তি পাবে না রে।
- মামা!
- এ'টা রাখ।
- এ'টা কী?
- খাম। ভিতরে চিঠি হলেও হতে পারে।
- কার জন্য?
- বোধ হয় অনিন্দ্যর জন্য। ওই, যার ডিফারেন্সিয়েশনে দারুণ গ্রিপ।
- না মানে...।
- ভেবেছিল তুই আসবি।
- মানে...।
- বাড়ির লোককে ভুজুংভাজুং দিয়ে একাই প্ল্যাটফর্মে গেছিল ট্রেন ধরতে। ঢাউস দু'টো সুটকেস সমেত। এ তো আর দু'চার দিনের জন্য যাওয়া নয়।
- আসলে...।
- আজ ভজা ডুব দিয়েছে, বাড়িতে কাগজ আসেনি। স্টেশনে গেছিলাম আনন্দবাজারের এক কপি নিতে। ডাগর চোখ বুঝলি।
- ইয়ে...।
- আমি আবার ছলছল টলটল দেখতে পারি না।
- কিন্তু...।
- উপায়ন্তর না দেখে আমাকেই চিঠিটা দিয়ে দিলো।
- হয়েছে কী...।
- তুই থাক বরং ঘাটে। আমি আসি। অনিন্দ্য এলে বলিস ছোটমামার প্লাইউডের দরকার। ধানবাদ থেকে সস্তায় যদি কিছু...।
- তিনটের লোকাল ছিল। এতক্ষণে নিশ্চই...।
- তিনটের লোকাল? চলে গেছে।
- ও...।
- তবে সে আছে। বসে। একটা আনন্দমেলা মুখের সামনে মেলে; ডেফিনিটলি পড়ছে না। পরের ট্রেন চারটে দশ। তবে সে'টা মিস করার উপায় নেই, নয়তো হাওড়া থেকে কালকা মিস।
- মামা, তুমি বাইকে এসেছো, না?
- এই যে চাবি। তোর সাইকেলের চাবিটা আমায় দে।
- মানে, আসলে...।
- ডিফারেনসিয়েশনানন্দ অনিন্দ্য এলে আপ্যায়ন করতে হবে না? বাদামের প্যাকেটটাও দিয়ে যা।
- হেহ্। আসি মামা।
- গ্রিপ দীপু গ্রিপ। মেয়েটা ভালো, তুই সেমি-ভালো। সাবমিট। আর যা দিনকাল পড়েছে, প্ল্যাটফর্ম টিকিট কাটতে ভুলিস না।

2 comments:

Unknown said...

অসাধারন!

শান্তনিক বসাক said...

কতশো বার যে এই লেখাটা পড়েছি তার হিসেব নেই .....যতবার পড়ি একইরকম ভালোলাগা