Skip to main content

দীপু ও ডিফারেনসিয়েশন

সাইকেলটা ঘাটের বেঞ্চিটার কাছে দাঁড় করালো দীপু। দুপুরের এ সময় এ'দিকটা বিলকুল শুনশান। শীতের নরম রোদ, গাছগাছালির ছায়া আর নদীর ভেজা হাওয়া মিলে চারদিকে একটা ছ্যাঁতছ্যাঁতে ব্যাপার। ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নেমে সাত নম্বর সিঁড়িতে বসে পিঠের ব্যাগটা নামিয়ে রাখলো। আর খান পাঁচেক সিঁড়ি ভাঙলেই জল।

আকাশটা সামান্য ফ্যাকাশে,তবে মেঘলা নয়। ও'পাড়ের জুটমিলের ভেঁপুতে সামান্য বিরক্ত হলো সে। নদীর ধারে গাছের পাতার খসখস আর পটাদাদার ঘটিগরম বানানোর খচরমচর ছাড়া কোনও শব্দই মানায় না। হাতঘড়িতে দেখলে; পৌনে তিন। অর্থাৎ আড়াইটে থেকে তিনটের মধ্যের যে'কোনও একটা সময়। দম দেওয়া এইচ-এম-টি'টা মেজদাদুর; সময়ের সাথে বিশেষ তাল রাখতে পারে না। কিন্তু দীপুর সয়ে এসেছে। পছন্দের কাজ থাকলে মিনিট পনেরো আগে পৌঁছে যায়। আবার বিপ্লববাবুর টিউশনিতে নিয়ম করে পনেরো মিনিট দেরী করে যায়। ঘড়িটায় ভরসা না থাকলেও, একটা বেড়াল-গোছের মায়া পড়ে গেছে।

খুব মন দিলে নদীর শান্ত স্রোতের শিরশির কানে আসে। পায়ের চটি খুলে বাবু হয় বসে বুকপকেট থেকে সল্টেড বাদামের প্যাকেট বের করে ছিঁড়লে সে। মিঠে হাওয়া আর বাদাম চিবুনো আরামে চোখের পাতা সামান্য ভার হয়ে এসেছিল। তখনই পিঠে একটা জমকালো থাপ্পড়ে ঘুরে তাকাতে হল।

- আরে, মামা? তুমি এ'খানে?
- কেন চাঁদ? নরসিমহা রাওকে এক্সপেক্ট করছিলে?
- না মানে...।
- দিদি বললো তুই জয়েন্ট স্টাডি করতে বেরিয়েছিস।
- হ্যাঁ...ওই অনিন্দ্যর সাথে। ডিফারেনশিয়েশনটা এত ভালো গ্রিপে রেখেছে ছেলেটা...।
- তা, গঙ্গার ধারে আজকাল জয়েন্ট স্টাডি হচ্ছে?
- প্রকৃতির সাথে ক্যালুকালসের নাকি নিবিড় যোগাযোগ, আইনস্টাইন না মিলটন কে একটা বলেছিল যেন।
- অনিন্দ্য, নাকি?
- পাতিপুকুরের দিকে থাকে। সেভেন থেকে আমার সাথে পড়ছে। ওর বাবার ধানবাদে প্লাইউডের ব্যবসা...।
- বসি খানিকক্ষণ..।
- উঁ।
- বাদাম দে দেখি দু'চারটে।
- এই যে।
- হ্যাঁ রে দীপু..।
- বলো।
- তুই চাকরীবাকরীতে উন্নতি করবি কী করে বল তো?
- তুমিও টেস্টের নম্বর নিয়ে খোঁটা দেবে মামা?
- নম্বর? আরে ধ্যুর। এগজ্যামিনের নম্বরের সাথে চাকরীর উন্নতির কোনও সম্পর্ক নেই। তবে মিথ্যে বলতে পারার সাথে আছে।
- মা...মানে?
- এত পুওর কোয়ালিটির মিথ্যে বলিয়ে হলে বস ম্যানেজ করবি কী করে? আর বস পকেটে না থাকলে যে তোকে বসে থাকতে হবে।
- ধুস।
- দীপু।
- মামা।
- স্টিমারে করে বা মধুকাকার নৌকায় করে কেউ কোনওদিন দিল্লী গেছে শুনেছিস?
- কী যে বলো! দিল্লী।
- এখান থেকে ট্রেনে হাওড়া, উসকে বাদ  কালকা মেল।
- তাতে আমার কী? অনিন্দ্য এসে পড়লো বলে।
- আমি যাচ্ছিলাম ক্লাবে। সমর ব্যাটার সঙ্গে ক্যারমে একটা ডুয়েল ছিল, বুঝলি? ঝড়ে বক দু'টো গুটি ফেলতে পারে বলে বড্ড মাতব্বরি বেড়েছে।
- তা ক্লাবে না গিয়ে এ'খানে এলে কেন?
- তুইও স্টেশনে না গিয়ে এ'খানে এলি কেন?
- আমি স্টেশনে গিয়ে কী করবে?
- আরে! দত্তবাড়ির ছোটমেয়ে কি মধুকাকার নৌকায় চেপে দিল্লী যাবে?
- দত্তবাড়ির...। তা'তে আমার কী?
- অনিন্দ্যর আত্মা শান্তি পাবে না রে।
- মামা!
- এ'টা রাখ।
- এ'টা কী?
- খাম। ভিতরে চিঠি হলেও হতে পারে।
- কার জন্য?
- বোধ হয় অনিন্দ্যর জন্য। ওই, যার ডিফারেন্সিয়েশনে দারুণ গ্রিপ।
- না মানে...।
- ভেবেছিল তুই আসবি।
- মানে...।
- বাড়ির লোককে ভুজুংভাজুং দিয়ে একাই প্ল্যাটফর্মে গেছিল ট্রেন ধরতে। ঢাউস দু'টো সুটকেস সমেত। এ তো আর দু'চার দিনের জন্য যাওয়া নয়।
- আসলে...।
- আজ ভজা ডুব দিয়েছে, বাড়িতে কাগজ আসেনি। স্টেশনে গেছিলাম আনন্দবাজারের এক কপি নিতে। ডাগর চোখ বুঝলি।
- ইয়ে...।
- আমি আবার ছলছল টলটল দেখতে পারি না।
- কিন্তু...।
- উপায়ন্তর না দেখে আমাকেই চিঠিটা দিয়ে দিলো।
- হয়েছে কী...।
- তুই থাক বরং ঘাটে। আমি আসি। অনিন্দ্য এলে বলিস ছোটমামার প্লাইউডের দরকার। ধানবাদ থেকে সস্তায় যদি কিছু...।
- তিনটের লোকাল ছিল। এতক্ষণে নিশ্চই...।
- তিনটের লোকাল? চলে গেছে।
- ও...।
- তবে সে আছে। বসে। একটা আনন্দমেলা মুখের সামনে মেলে; ডেফিনিটলি পড়ছে না। পরের ট্রেন চারটে দশ। তবে সে'টা মিস করার উপায় নেই, নয়তো হাওড়া থেকে কালকা মিস।
- মামা, তুমি বাইকে এসেছো, না?
- এই যে চাবি। তোর সাইকেলের চাবিটা আমায় দে।
- মানে, আসলে...।
- ডিফারেনসিয়েশনানন্দ অনিন্দ্য এলে আপ্যায়ন করতে হবে না? বাদামের প্যাকেটটাও দিয়ে যা।
- হেহ্। আসি মামা।
- গ্রিপ দীপু গ্রিপ। মেয়েটা ভালো, তুই সেমি-ভালো। সাবমিট। আর যা দিনকাল পড়েছে, প্ল্যাটফর্ম টিকিট কাটতে ভুলিস না।

Comments

Unknown said…
অসাধারন!
কতশো বার যে এই লেখাটা পড়েছি তার হিসেব নেই .....যতবার পড়ি একইরকম ভালোলাগা

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু