Skip to main content

বলরামবাবুর শখ

নিউ ক্যালক্যাটা হার্ডওয়্যারের দোকানটা থেকে উত্তরের দিকে মিনিট পাঁচেক হাঁটলে একটা সরু গলি বাঁ দিক থেকে রাস্তায় এসে মেশে। গলিটার মুখেই একটা ল্যাম্পপোস্ট। শীত আর নিস্তব্ধতা মিলে ল্যাম্পপোস্টের বাতিটার নিভু নিভু আবেশে একটা ছন্দ এনে দিয়েছিল।

সে'খানে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালেন বলরাম দত্ত। হাতঘড়িতে তখন রাত পৌনে বারোটা। তবে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। মিনিট দশেকের মধ্যেই একটা রিক্সা এসে থামল তাঁর সামনে।
রিকশাচালকের নরম সুরের"উঠে পড়ুন"য়ে ভর দিয়ে রিক্সায় উঠে বসলেন তিনি।

নার্ভাসনেস, শীত আর রাত মিলে যে রিনরিন বলরামবাবু গা জুড়ে অনুভব করতে পারছিলেন, সে'টা স্তিমিত হতে মিনিট সাতেক সময় লাগল। রিক্সা ততক্ষণ অবশ্য থেমে থাকেনি। গলার শুকনো কাঠ ভাবটা কেটে যেতেই, হাওয়ার বরফ শীতলতায় মোচর দিতে কথা শুরু করলেন বলরামবাবু নিজেই।

- আপনিই তবে...?
- আজ্ঞে।
- আমরা কোথায় যাচ্ছি?
- ইলিশ জলের কত ফুট নিচে ডিম পাড়ে জানেন?
- না। কেন?
- আমরা কোথায় যাচ্ছি জেনে কী করবেন? আপনার কাজ হওয়া নিয়ে কথা।


**

পাড়ার এত কাছে এত নিরিবিলি জংলা আছে, সে'টা বলরামবাবুর জানা ছিল না। রিক্সা থেকে যখন নামলেন তখন রাত পৌনে একটা। মেঘলা আকাশ, তবুও অন্ধকার নিকষ নয়। আকাশে একটা ফ্যাকাসে ভাব। গায়ের শালটা আরও ভালো ভাবে জড়িয়ে নিলেন বলরামবাবু। আশেপাশে প্রচুর তাল গাছ। জায়গাটায় একটা মায়া মেশানো ছমছম রয়েছে। ফের বলরামবাবুই কথা শুরু করলেন;

- শুনছেন?
- হুঁ।
- রিক্সাটা এখানে দাঁড় করালেন কেন ভাই?
- এখানেই। কাজ হবে।
- এখানে, মানে... ।
- কেন? পছন্দ হল না? অনেক যন্ত্রপাতি দেখবেন আশা করেছিলেন?
- না মানে...ভেবেছিলাম পুজোঅর্চনার ব্যবস্থা থাকবে। বা অন্তত একটা সুসজ্জিত ল্যাবরেটরি।
- রিক্সাওলার ল্যাবরেটরি?হাসালেন।
- এ'টা আপনার বিনয়।
- প্রথম কন্ডিশন। আমার নাম ধরে ডাকা বারণ। তা'তে আমার কাজে অসুবিধে হয়।
- ওহ, ডাকব না?
- রিক্সাদা বলে ডাকতে পারেন।
- ওহ, সেই যে গতকাল রাত্রে আপনার সাথে আলাপ! সেই থেকে দু'চোখের পাতা এক করতে পারছি না।
- কেন?
- আপনার মত তন্ত্র-সাধকের সাথে আলাপ হওয়াটা...।
- তন্ত্র-সাধক! হুহ্‌। যদি তেমনটাই হতাম, তাহলে তো এদ্দিনে রিক্সা ঠেলে হন্যে হতে হয়? এই আপনিই একমাত্র আমার ক্ষমতায় বিশ্বাস রেখে ভেলকি দেখতে চাইলেন। নয়তো সচরাচর কেউ রাজী হয় না।
- আপনার কথাগুলো সব বুঝলাম না। তবে আপনাদের ভাবনা যে উচ্চমার্গের হতেই হবে, এবং তা সাধারণের বোধগম্য হবেই বা কেন! আচ্ছা, রিক্সা চালানোটা জাস্ট জনগণের চোখে ধুলো দেওয়া, তাই তো? এই রিক্সা হচ্ছে আপনার হিমালয়। ঠিক বুঝেছি তো?
- এই রিক্সা। এই রিক্সা আমার জেলখানা বলরামবাবু। সে কথা থাক। যে কথা দিয়ে আপনাকে এদ্দূর ধরে আনা। সে ভেলকিটা আপনাকে দেখিয়ে দিয়ে হবে।
- থ্রিলিং। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে স্যার, আই মীন, রিক্সাদা। সত্যিই আমায় ভূত হওয়ার অভিজ্ঞতা টের পাওয়াবেন? উফ! দারুণ!
- ব্যাপারটা তেমন দারুণ নয় বলরামবাবু। যন্ত্রণারও বটে। ভাবুন। মানুষ মরে ভূত হয়। কিন্তু আপনি ভূত হতে চলেছেন মরার ব্যাপারটা উহ্য রেখে।
- যন্ত্রণা? ফিজিক্যাল পেন?
- শরীর বেচারি আর কতটুকুই বা ব্যথা ধারণ করতে পারে। আপনি প্রস্তুত?
- কোন যাগযজ্ঞের দরকার হবে না? কোনও হিংটিংছট? আর ইয়ে, ওই ব্যাপারটা মনে আছে তো?
- কোন ব্যাপার?
- ভূতের অভিজ্ঞতা হয়ে গেলেই ফের মানুষ হয়ে যেতে হবে কিন্তু আমাকে। এই দিন দুয়েকের মামলা। তারপরেই স্কুল খুলছে। আমি ইংলিশের ক্লাস নিই, গোবর্ধন মেমোরিয়াল হাইস্কুলে। কামাই করার একদম উপায় নেই, বুঝলেন?
- আপনার স্কুল কামাই হবে না বলরামবাবু। পাঁচুর যেমন রিক্সা চালানো বন্ধ হয়নি।
- পাঁ...পাঁচু কে?
- পাঁচু? রিক্সাওলা। ভূত হয়ে কেমন লাগে, সে'টা জানার লোভ ওরও হয়েছিল জানেন। এই, এতগুলো তালগাছের যে কোনও একটাতেই পাঁচুকে পাবেন। খুঁজে নেবেন কেমন? আমার আদত নাম গোকুল চ্যাটার্জী। ক্লাস নাইনে এক তান্ত্রিকের চ্যালা হয়ে ঘর ও দেশ ছাড়ি। বেয়াল্লিশ বছর বয়সে তিব্বতে গিয়ে এক লামার থেকে শিখে এসেছিলাম এ ব্যাপার। বিশ বছর কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছিল। মুশকিল হচ্ছে একবার কোনও দেহ ছাড়লে, তাতে আর ওয়াপিস যাওয়া যায় না। দেহগুলো নষ্ট হয়। আমারটাও সে'ভাবেই গেছিল।
- আ...আপনার সে'ভাবে... কী গেছিল?
- দেহটা। পাঁচু আমার ফ্যামিলি-রিক্সাওলা ছিল। ভূত হওয়ার লোভে গিনিপিগ হতে আপত্তি করেনি। তবে তখনও ভাবিনি যে ওকে ওর দেহ ফেরত দিতে পারব না। কিন্তু কাহাতক ভালো লাগে বলুন তো রিক্সা টানতে? কাজেই এদ্দিন পর যখন কেউ ভূত হতে রাজী হলো, তাও আবার সে যখন ইংরেজির মাস্টার, লোভ সামলাতে পারলাম না। আপনাদের তো সুখের চাকরী মশাই!
- আপনি যে কী বলছেন...আমি কিছুই...।

***

কোন কিছু ঠাহর করার আগেই বলরামবাবু টের পেলেন তিনি পতপত করে হাওয়ায় উড়ছেন। প্লাস্টিকের প্যাকেটের মত রাতের হিম মাখানো আবছা আলোয় ভেসে চলেছেন কনকনে হাওয়ায়। ভাসতে ভাসতে একটা তালগাছের মাথায় চলে এসেছিলেন প্রায়। নিজের যেন কোনও ওজনই নেই। গলায় স্বরও নেই। অসীম, অমোঘ নিশ্চিন্দি। অথচ এক বিকট কাঁপুনি নির্ভার দেহ জুড়ে। অবশ্য পরক্ষণেই টের পেলেন , দেহ-টেহ কিস্যু নেই। তিনি ভাসছেন এক রাশ বেপরোয়া হাওয়ার মত। এক পশলা মন কেমন করা গন্ধের মত। বুকে ছ্যাঁত ধরানো এক মুঠো নীলচে আলোর মত।

অত ওপর থেকেও বলরামবাবু স্পষ্ট দেখতে পারছিলেন পাঁচু রিক্সাওলার নিথর দেহ মাটিতে চিৎপাত হয়ে পড়ে। আর অবিকল তাঁর চেহারার মত কেউ রিক্সা চালিয়ে রওনা দিয়েছে শহরের রাস্তা ধরে।

Comments

Shromana Chatterjee said…
office er vireo kemon jeno ga chomchom feeling holo...

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু