Skip to main content

কুঞ্জবনে

- গুরু!
- ইয়েস বস।
- আরেক টান হবে নাকি?
- নাহ্। এটুকুই। থাক বরং।
- মিইয়ে গেছ দেখছি?
- আমি? মিইয়ে? আরে না না! আর্কিমেডিস এখন আমায় দেখলে ইউরেকা ইউরেকা বলে লাফাতে পারতেন। ফ্লোট করছি কিনা। দুঃখের যতটা ওজন, ততটাই স্ফুর্তির জল ডিস্পলেস করছি। উথাল পাথাল, কিন্তু ডুবে যাওয়ার চান্স নেই।
- দুঃখ? গুরু? আমি থাকতে তোমার দুঃখ?
- আসে, যায়। যায়, আসে। দে। অত জোর করছিস যখন। বামুন মানুষ, দু'টানে তো আর জাত যাবে না। না নিলে বরং তুই খারাপ পাবি।
- এই যে গুরু।
- আহহহহহহহ, বুকের আগুনপানা স্টোভে কেউ জল ছিটিয়ে দিলে রে।
- বল না গুরু। অমন ম্যাদা মেরে কেন রয়েছ!
- ম্যাচোমাস্তানদের ম্যাদা মারতে আছে রে পাগলা?
- বত্রিশ বছর ধরে ট্রাকের খালাসি গুরু। অল ইন্ডিয়া পারমিটের। তার মধ্যে সাড়ে একত্রিশ বছর তোমার পায়ের কাছে বসে "ডাইনে লেও বাঁয়ে লেও" করে গেছি। তুমি হ বলতে আমি হরিদাসের ধাবার ডিম তড়কা বুঝি গুরু। ডবল ঝাল।
-  হ'য়ে হরিদাসের ধাবার তড়কা। আহা। তোর এ জীবনে কবি হওয়ার কথা ছিল রে। ট্রাক ধুয়ে আর মুন্নি বদনামে উজাড় হয়ে গেলি। একটু যদি কেউ তোকে বিভূতিভূষণে ঠেলে দিত। সময়মত। তবে। তবে আমিও তো ঠেলিনি। তোর কোনও দোষ নেই রে। কবিদের কোনও দোষ থাকে না।
- গুরু। কী হয়েছে?
- কেমিস্ট্রিতে মাস্টার্স শুধু নয় রে, ইউনিভার্সিটি কাঁপানো রেজাল্ট।
- জানি গুরু। তুমি কলেজে টপাটপ পাশ দিয়ে ট্রাক চালাতে এসেছো। কিন্তু সে তো বছর পঁয়ত্রিশ আগের কেস! এখন ব্যথা শুরু হল?
- ধুর। ট্রাক আর ন্যাশনাল হাইওয়ে তো আমার হিমালয় রে! শুধু কৌপীনের বদলে লুঙ্গি।
- তবে? গুরু? নেতিয়ে পড়েছ যে বড়?
- জানিস...।
- গুরু!
- "কোয়েলা ডাকল আবার, যমুনায় লাগল জোয়ার; কে তুমি আনিলে জল ভরি মোর দুই নয়নে"!
- আইব্বাস!
- কী?
- তোমার গলায় সুর রয়েছে গুরু!
- গাঁজা। গাঁজা সুর ঢালে। গলায় না। কানে।
- গুরু! গাও না।
- সন্ধ্যের বারান্দা জানিস। বৃষ্টির।  ঝিরঝির দেখা যায় ল্যাম্পপোস্টের বাতির তলে। উঠোনের জুঁইয়ে বাতাস ভার। মা গানের ভালো লাগায় চোখ বুজে ফেলেছেন। আমি ভ্যাবলার মত বসে মায়ের আঁচল চিবুচ্ছি। দু'জনেই অপেক্ষায়। বাবা আসার সময় হয়ে এসেছে। মা গাইছেন। গাইছেন। সেই। গানে জুঁইয়ে ডুবে ভাসছি। সন্ধ্যে মায়ের গান বেয়ে তরতর করে এগিয়ে চলেছে। "আজি মোর শূন্য ডালা, কী দিয়ে গাঁথব মালা? কেন এই নিঠুর খেলা খেলিলে আমার সনে, কে আবার বাজায় বাঁশি এ ভাঙা কুঞ্জবনে, হৃদি মোর উঠল কাঁপি চরণের সেই রণনে"।
- গুরু। আঁখো মে পানি। ম্যাচো মাস্তানা?
- হেহ। শোন। বৃষ্টি বেড়ে যাচ্ছিল। বারান্দার বাইরের সে অন্ধকারে রাস্তার আবছা হলদে আলোর মায়া আর মা মেশানো। বারান্দার গ্রিলে মাথা রেখে মা গুনগুনিয়ে চলেছিল; "হয় তুমি থামাও বাঁশি, নয় আমায় লও হে আসি-ঘরেতে পরবাসী থাকিতে আর পারি নে, কে আবার বাজায় বাঁশি এ ভাঙা কুঞ্জবনে"।
- আহ। গুরু।
- আসেনি।
- হুঁ?
- বাবা। আসেনি। আর কখনও। ট্রাকচাপা পড়ার পর ফিরলে অবশ্য ব্যাপারটা ভয়েরই হত।
- ও।
- সেই শেষ মাকে গাইতে শোনা। জানিস! সেই শেষ। মা আর কথাই বলতে পারতেন না, তো গান। গান ছাড়া মাকে চিনিনি। গান যাওয়াতেই মা চলে গেছিল। তাই গান ছাড়া মাকে ছেড়ে আসতে কোনও কষ্ট হয়নি।
- গুরু। আরেক টান নেবে?
- আজ...আজ নাকে ফের জুঁইয়ের গন্ধ এলো। মাই ডিয়ার খালাসিবাবু, দ্য কুঞ্জবন ইস ডেসার্টেড। বাট দ্য মিউজিক প্লেস অন। আমি এদ্দিন শুধু শুনতে পেতাম না। মাকে পাথর ভেবে পালিয়ে এলাম অথচ সে সুর ডাকাত হয়ে কলার টেনে রাখলে।
- গুরু।
- মা! মাগো। আয়দার লেট দ্য মিউজিক গো অর পুল মি ক্লোজার। ক্লোজার। "হয় তুমি থামাও বাঁশি, নয় আমায় লও হে আসি - ঘরেতে পরবাসী থাকিতে আর পারি নে"।
- জী। গুরু। এ'বার চলো।
- হুঁ। এইবার।

Comments

Mohua Roy said…
Ki likhecho Guru!! Puro emossion e mossion choley asslo.
sanbandyo said…
Awnobodyo hoyechhe eta. Khubi bhalo laglo.

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু