Skip to main content

পুজোর আমি

বয়স বাড়ছে।
ভিড়ে তিতিবিরক্ত লাগে।
পুজোবার্ষিকী পত্রিকাগুলো নিরস লাগে।
পুজো এলেই পকেটে যন্ত্রণাময় টান পড়ে।
Peer প্রেশার আর পিয়ার প্রেশারে হিমাচল কাশ্মীর প্ল্যান করে নাভিশ্বাস উঠে যায়।
বারবার গজরগজর করে যাই- আলসে বাঙালির এ সেন্টিমেন্ট ঝুঠা।
বারবার বুক ঠুকে বলে যাই 'কিস্যু ম্যাটার করে না, আলটিমেটলি বিজয়ার ওপারে অফিস। এন্ড অফ স্টোরি'।

তবু।
অষ্টমীর সন্ধ্যেয়। প্রবাসের এই অচেনা পুজো মণ্ডপে এসে একটা নধর 'তবু' দাঁত বের করে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে।

**

দিল্লীতে বেমক্কা ঘুরে বেড়াচ্ছি। কারণ পুজোর গোটাদিন সোফায় শুয়ে বসে থাকলে পাঁচজনে পাঁচ কথা বলবে। চিত্তরঞ্জন পার্কের অষ্টমীরল ভিড়ের বহর দেখে স্রেফ পিঠ বাঁচিয়ে সরে পড়া। তবে সন্ধ্যের আগে অষ্টমীতে বাড়ি ফিরলে লোকে কাপুরুষ বলবে।

অতএব ভিড়ের দমবন্ধ করা দাপট বাঁচিয়ে খুঁজেপেতে পৌঁছলাম কাশ্মীরিগেটের পুজোয়। ভিড় রয়েছে, তবে বেসামাল নয়। খালি চেয়ার দিব্যি গড়াগড়ি যাচ্ছে এ'দিক ও'দিক। চায়ের কাপ হাতে বসে জিরিয়ে নেওয়া যায়। মণ্ডপে ততক্ষণে সন্ধিপূজার আবহ।

ধূপ ধুনোর গন্ধ, পুরোহিতের ব্যস্ততা, ভলেন্টিয়ারদের অমায়িক দৌড়ঝাঁপ। গৌতম ভট্টাচার্যের চোখ থাকলে দেখা যেত পঞ্চপ্রদীপের আলোয় দেবীমুখের হাসি যেন আজ সামান্য বেশি চওড়া।

তারপর। ঢাকের কুড়কুড়কুড়কুড় যে মুহূর্তে গোটা মণ্ডপের বাতাসে মিশে যেতে শুরু করল, সে মুহূর্তে সেই 'তবু' সামনে ঝপাৎ করে এসে পড়লে।

যতই যা কিছু গোল্লায় যাক।
'তবু'। পুজো তো।

**

মফস্বলে বেড়ে ওঠা। কলকাতার থীম দূরঅস্ত। পাড়ার পুজোর বাইরে এলাকার অন্য পুজোও তেমন ভাবে দেখা হয়ে উঠত না। দেখার প্রয়োজন হত না।

পুজো কনসেন্ট্রেটেড হয়ে থাকত পাড়ার মণ্ডপে।
আর পুজো পুজোতে কনভার্ট হত চব্বিশ ক্যারাটের ইয়ারদোস্তদের সান্নিধ্যে। পুজোর মত সুগভীর বন্ধু-ফিল্টার খুব কম পেয়েছি।

ষষ্ঠী টু দশমী। জলখাবারের পর থেকে দুপুরের মাংস ভাতের আগে পর্যন্ত আস্তানা ছিল পাড়ার মণ্ডপ। দুপুরের আড্ডা কোনও এক বন্ধুর বাড়িতে। বিকেল থেকে ফের মণ্ডপে। সকালের প্রসাদ, বিকেলের ভোগ কোনওটা বাদ যেত না। পাড়ার নাটক, জলসা; সবেতেই রুদ্ধশ্বাস ব্যাপারটা দপদপ করে থাকত।

খান ছয়েক চেয়ার গোল করে পেতে গল্প হত। বই ক্যাসেট হাতবদল হত। কন্ট্র‍্যাব্যান্ড এ'দিক থেকে ও'দিক হত।  আর রইত খাওয়াদাওয়া। তখন সকলের পকেটেই চ্যারিটির টু'পাইস। আলুর দম টু ফুচকা টু ঘুগনি টু রুটি তড়কা; সে'টুকুই। বড়জোর বরাতজোরে একবার স্টেপ আউট করে দি গ্রেট শাহাজাদী রেস্তোরাঁর ফ্রায়েড রাইস ও দু'প্লেট চিলি চিকেনে ছ'জনের ডাইভ। কিন্তু ওই। অমৃত ইজ আ স্টেট অফ মাইন্ড।
খোকাবেলা থেকে কলেজ, পুজোর রুটিন এদিক সেদিক হয়নি একবারও।

তেমনই এক পুজোর দুপুরেই প্রথম বিভূতিভূষণ ধরিয়েছিলে এক বন্ধু। ক্লাস ফোর। চাঁদের পাহাড়।

পুজোর বিকেলে গঙ্গার ঘাটে প্রথম সিগারেট। সম্ভবত অষ্টমীতেই।

প্রথম "মৌ মেয়েটাকে তোর কেমন লাগে?"। আমি বললাম "দিব্যি", সে'দিন সপ্তমী। বন্ধুটি স্নেহের সাথে মাথা নাড়লে। সে বন্ধুই নবমীর দুপুরে বললে "তোর সাথে মৌ দেখা করতে চেয়েছে। ওদের বাড়ির পাশে কলতলায়। এখুনি। সিক্রেট কিন্তু"। বুকে হাতুড়ি, হাতের তালুতে ঘাম। বন্ধুর সাথে হাজির কলতলায়। দুপুর তিনটে। মৌকে দেখিয়ে আমায় এগিয়ে দিলে বন্ধুটি।
আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মৌয়ের চাবুক "তুমি আমার সাথে একলা দেখা করতে চেয়েছ কেন? মতলবটা কী?"।
গলা শুকিয়ে কাঠ। বলতে চাইলাম "আমি ডাকিনি, মাইরি"। মুখ দিয়ে বেরোল "সরি"। পিছনে তাকিয়ে দেখলাম গুলসম্রাট হাওয়া।

পুজোর কোনও এক বিকেলে শোনা এক ভদ্রলোক স্রেফ একটা গিটার নিয়ে গাইছেন। গাইছেন এমন একজনকে নিয়ে  যে একটা বেঢপ সাইজের ব্যাগ নিয়ে একটা ছুটন্ত বাসের ফুটবোর্ডে ওঠার জন্য মরিয়া। তাকে নিয়ে গান হয়? এ সুর এমন অন্য কেন? এক বন্ধুর বাড়ির ছাতের ঘরে সন্তোষ স্টিরিওতে প্রথম শোনা সেই গান। সেই। পুজোর বিকেলে।

পুজোর দুপুরেই হাতেখড়ি ট্যুয়েন্টি নাইনে। আলসের গ্ল্যাডিয়েটরগিরি। মসৃণ, বাতেলায় মেদুর, রঙের খেলা। আহা।

পুজোয় প্রথম নেশার রঙ চেনা।
আবছায়া রাত। কুচোনো শসা আর বাদাম ভাজার মুচমুচে স্বাদে মিলেমিশে যাওয়া ওল্ড মঙ্ক। মাথা বুকের ভিতরের রিমঝিম।
সিদ্ধি বানানোর দুপুর। বিজয়ার টলে যাওয়া পা মাথার সন্ধ্যে। তারপর পেটে গুজিয়া পড়লে আর রক্ষা নেই। "ভাই তোরা আছিস তাই আছি, ছেড়ে যাস না"। এক পা ফেলতে দুই পা এগোনো। হাসলে হাসি থামে না, অথচ মাঝেমাঝে কান্না ভসভসিয়ে বুক বেয়ে উঠে আসে।

কত গল্প, কত গল্প, কত গল্প। কত জমে থাকা গল্প ঝুলি থেকে বের করে আনার পুজো। পুজো। পুজোর সন্ধ্যে। জ্বলজ্বলে পাড়ার মণ্ডপ। সন্ধ্যারতির শেষে শালপাতার দোনায় খিচুড়ি লাবড়া। সকলের মুখ আলো আলো। ঢাকে কাঁসরঘণ্টায় মেহফিল গুলজার। কত ভালোবাসার সে'সব সন্ধ্যে।

**

সমস্ত আলসেমি ও তিতিবিরক্তিকে ছয় গোল দিয়ে নাকে পুজোর সে গন্ধ ফিরে এলো।
এই আধচেনা শহরের বেপাড়ার পুজোয়। আজ সন্ধ্যায়।

এই কাশ্মীরি গেটে কত মুখকে পরিচত মনে হল। ইয়ারদোস্তের দল। শশব্যস্ত পাড়াকাকুদের দল। ভোগ বিতরণ সুপারভাইজ করার দাপুটে কমিটিদাদা। হাতে হাত রেখে ঘুরঘুরের ছেলেমেয়েরা।

সমস্ত দুদ্দাড় করে ফিরে এলো। আমার পাড়া। আমার বন্ধুরা। আমার পুজো।

জলে যাক পুজোবার্ষিকী। সেভিংস গোল্লায় যাক। পানমশলার হোর্ডিঙে শহর ছেয়ে যাক। বাঙালির ফাঁপা কালচার বাতিকে প্রাণ ওষ্ঠাগত হোক।

তবু। আমার পুজো আমার থাক। আমার পুজো আমার পাড়ায় থাক। আমার পুজো আমার বন্ধুদের ছুঁয়ে থাক।

আমি পুজো ভালোবাসি, এন্ড অফ দ্য স্টোরি।

Comments

Anonymous said…
Asadharon !!

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু