১।
গোটা দুপুর নিজেকে ছাদের ঘরে আটকে রেখে কেঁদেছে
সুলিয়া। খুব কেঁদেছে। বাবা, মায়ের হাজার ডাকেও সাড়া দেয়নি। খায়নি। খিদে নেই। বুকে
ফেটে যাওয়া যন্ত্রণা। প্রেম ভাঙার দুঃখ যতটা, তার চেয়েও বেশি দুঃখ তার নিজের বাবা
এমন কাজ করলো বলে। কী করে? ছিঃ। ছিঃ।
২।
- তুমি কি ঠিক করলে
এটা ? আমাদের ওইটুকু মেয়ে, না হয় প্রেমে পড়েছে। এ বয়েসে তো এমনটা হতেই পারে। তাই
বলে এমনটা –
- সুলিয়া আমারও মেয়ে।
বাবা হিসেবে কী করে মেনে নেব যে আমার মেয়ে একটা ভিন-গ্রহের কোন অজ্ঞাতকুলশীল কারোর
প্রেমে পড়বে ? মানছি ছেলেটাও আমাদেরই মত মানুষ। একই হাব-ভাব। ওদেরও ভাষা আছে।
সভ্যতা আছে। কিন্তু তার বাইরেও অনেক কিছু আছে সুলিয়ার মা। এই প্রেমের কোনও ভবিষ্যৎ
ছিল না।
- ওকে একটু বুঝিয়ে তো
বলা যেত, তার আগেই তুমি ছেলেটার প্রতি এমন...।
- সুলিয়া বুঝতে চাইছিল
না যে। দেখ সুলিয়ার মা। ব্যাপারটা বেআইনি। আমরা ওই গ্রহের মানুষজনের থেকে অনেক
উন্নত। তাই আমরা ওদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ভাবে অবগত অথচ আমাদের গ্রহ বা
সভ্যতা সম্বন্ধে ওদের কোনও ধারণা নেই। কিন্তু ওরা আমাদের অস্তিত্ব টের পেয়ে গেলেই মুশকিল।
পৃথিবীর অধিবাসীরা ভারি সুবিধার লোক নয় গো। ওদের ওখানে এখনও যুদ্ধের মত প্রাগৈতিহাসিক
ব্যাপার-স্যাপার রয়ে গিয়েছে। ভাবতে পারো ?
- সুলিয়া না হয় ভুল
করে ওই ছেলেটার সাথে যোগাযোগ করে ফেলেছে কিন্তু...।
- এ ভুলের মাশুল
সাঙ্ঘাতিক সুলিয়ার মা। সুলিয়ার প্রেমিক ছেলেটা যদি আমাদের কথা পৃথিবীতে প্রচার করে
দেয়, সেখানকার সমস্ত মানুষ আমাদের গ্রহে পৌঁছোবার জন্যে উঠে পড়ে লাগবে। লেগে থাকলে
পৌঁছেও যাবে আগামী একশো বছরের মধ্যে। সে এক ভারি বিপত্তির কথা। এবং সেই মহাপ্রলয়ের
দায় বর্তাবে আমাদের পরিবারের উপর। বুঝলে কিছু?
- কে জানে বাপু। তা
তুমি ছেলেটার সাথে দেখা করতে ওই গ্রহে যে গেলে, দেখা করে বললেটা কী যে সুলিয়া আর
ওর প্রেম এত সহজে ভেঙ্গে গেল ?
- ছেলেটা থাকে পৃথিবী
নামক গ্রহটির কলকাতা নামের এক শহরে। ছেলেটার সাথে কথা বলে বুঝলাম যে সুলিয়ার সাথে তার
সম্পর্ক যথেষ্ট গভীর। ইন্টার-গ্যালাক্টিক ওয়্যারলেস কলিং ডিভাইস
থেকে সুলিয়া নিয়মিত তার সাথে কথা বলে। সে অবশ্য আমি সুলিয়ার সেই কলিং ডিভাইস সহজেই
বিকল করে দিতে পারি। এবং করে দিয়েও ছিলাম। কিন্তু বিপত্তি হল অন্য জায়গায়। এবং তার
জন্যেই আমায় বাধ্য হয়ে এমনটা একটা কাজ করতে হল।
- কী করেছ বল তো তুমি?
- সুলিয়ার সেই প্রেমিক ছেলেটা আমাদের গ্রহের গোপনীয়তার ব্যাপারে একটা বড়
বিপদ। ছেলেটা যদিও কথা দিয়েছে যে আমাদের কথা কাউকে জানাবে না, কিন্তু আমরা
ভিন-গ্রহের কারোর আশ্বাসের উপর নিজেদের ভবিষ্যৎ ঝুলিয়ে রাখতে পারি না। ওর বেঁচে
থাকাটাই আমাদের জন্যে এখন একটা বড় চিন্তা। কিন্তু আমদের গ্রহের নিয়ম অনুযায়ী খুন
করা নিষিদ্ধ, অন্য গ্রহের কোনও প্রাণীকেও নয়।
- তারপর কী করলে ?
- আমি এমনি এমনি এ গ্রহের সেরা বিজ্ঞানী নই। কলকাতার পরিবেশ ও আবহাওয়া এখন
আমি আমাদের গ্রহে বসে নিয়ন্ত্রণ করি সুলিয়ার মা। সেই প্রযুক্তি আমারই আবিষ্কৃত।
- মানে ?
- মানে ছেলেটাকে আমি সহজ হুমকি দিয়ে এসেছি। যে সে যতদিন না আত্মহত্যা করছে,
কলকাতার আবহাওয়া আমি উত্তরোত্তর অসহ্য করে যাব। গ্রীষ্মের যন্ত্রণার পারদ প্রত্যেক
বছর একটু একটু করে বাড়িয়ে তুলবো। শীত হারিয়ে যাবে। বসন্ত ঝলসে যাবে। সে চোখের
সামনে দেখবে তার ভালোবাসার শহর একটু একটু করে পুড়ে যাচ্ছে এবং তার জন্যে দায়ী কেবল
সে। একটা গোটা শহর বিদঘুটে গরমে, খুনে আর্দ্রতায় ক্রমে ক্ষয়ে যাবে; যে ক্ষয়
প্রত্যেক বছর তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। শীতল ঝড়ের দল ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। শেষ
হয়ে যাবে তার শহর কলকাতা; উত্তাপে। তার চোখের সামনে। তার দোষে। সে আত্মহত্যা করছে
না বলে!
- তুমি এমন করতে পারলে
?
- সুলিয়ার মা। তুমি
বুঝবে না। ইতিহাস বুঝবে। আমাদের গ্রহের ইতিহাস জানবে, যে এ ছাড়া আমার কোনও উপায়
ছিল না।
৩।
আজও বোধ হয় পারবেন না । গত দশ বছরে এই নিয়ে অন্তত
তিরিশবার হবে। অমিত পারেননি। দম বন্ধ করা যন্ত্রণা। আত্মহত্যা না করতে পারার
যন্ত্রণা। এই বিকেলের ব্যস্ত হাওড়া ব্রিজ, অগুনতি মানুষ। অগুনতি গাড়ির দল। কিন্তু
রেলিং ডিঙিয়ে হুগলীতে ঝাঁপ কি সহজ। কি নির্মল। ঝাঁপ দিলেই নিশ্চিত।
কিন্তু বেঁচে থাকা কী সুন্দর। সুলিয়ার মত
সুন্দর। সুলিয়া এখন কেমন আছে ? সে কি তার কথা ভাবে ? হয়তো।
আত্মহত্যা না পারলেও, মৃত্যু-যন্ত্রণা বেশ অনুভব
করতে পারেন অমিত; এই দম-বন্ধ করা গরমের ছটফটে কলকাতায়। টগবগ করে ফুটে চলে কলকাতা;
প্রত্যেক গ্রীষ্মে পরিস্থিতির আরও একটু দুঃসহ হয়ে ওঠে। শহর জুড়ে হাহাকার।
গ্লোবাল-ওয়ার্মিং নিয়ে হা-হুতাশ। কিন্তু অমিত জানেন। বহু দূরের কোনও গ্রহে এক
মানুষ বা মানুষের মত কেউ সুইচের চাপে কলকাতাকে ইচ্ছে মত সেঁকে চলেছে। একেকটা বছর
চলে যায়, অমিত নিজেকে খুন করতে পারেন না আর সেই অদৃশ্য হাতের গ্রীষ্ম-থাপ্পড় ক্রমশ
আরও খুনে হয়ে ওঠে।
শুধু যখন অমিত আত্মহত্যার জন্যে প্রস্তুত হয়ে
দাঁড়ান (কখনও মেট্রো রেলের প্ল্যাটফর্মের ধারে, কখনও ঢাকুরিয়ায় রেললাইনের পাশে,
কখনও এই হাওড়া ব্রিজের ধারে); তখন আকাশে মেঘ করে আসে। মনে হয় যেন কালবৈশাখী উঠবে।
সেবার যখন হাওড়া ব্রিজের রেলিং বেয়ে অল্প উঠেছিলেন অমিত, ঝিরঝির বৃষ্টির সাথে দমকা
শীতল হাওয়ার দাপাদাপি শুরু হয়ে গিয়েছিল কলকাতা জুড়ে। কিন্তু ভয় যখন অমিতকে হাত
টেনে ধরে, মৃত্যুর মুখ থেকে টেনে আনে; গরমের সাঁড়াশি কলকাতার গলায় আরও সপাটে চেপে
বসে। অপরাধ বোধে গুটিয়ে আসেন অমিত।
কিন্তু কলকাতার ফুটন্ত কড়াইতে সেদ্ধ হয়ে বেঁচে থাকাও
যে মৃত্যুর চেয়ে কত সুন্দর তা বুঝতে পারেন অমিত। সুলিয়ার কথার মত সুন্দর। তার
কলকাতা। তার সুলিয়া। ছেড়ে চলে যাওয়া কি অতি সহজ ? আজও হাওড়া ব্রিজের রেলিং টপকানো
হল না অমিতের। আকাশের সামান্য মেঘ সাফ হয়ে গিয়ে যথারীতি গনগনে রোদ আরও খুনে মেজাজে
আঁকড়ে ধরল কলকাতাকে।
Comments
গুড রিড। ভালো লেগেছে :)
Tenders And Consulting Opportunities in
Bangladesh.