Skip to main content

উমাপদ-আহার-সেন্টার ও স্টেটাস

দুর্গাপুরে যে পাড়ায় আমাদের বাড়ি, সে পাড়ার এক কোনে ছোট্ট বাজার। বাজারের কোনে ছোট্ট  ভাত-রুটির হোটেল। উমা-আহার-সেন্টার। মালিক উমাপদ সমাদ্দার। পিছনে রান্নাঘর। সামনের চত্বরে পাঁচটা পুরনো কাঠের টেবিল আর খান কুড়ি চেয়ার। দোকানের সামনে মেনু-বোর্ড টাঙানো। আর দেওয়ালে টাঙানো সেই মেনু-বোর্ড আর মা তাঁরা ফার্নিচারের ক্যালেন্ডারের নিচে ভাব-গম্ভীর মুখে বসে থাকেন উমাপদবাবু। তাঁর সামনের টেবিলে হিসেবের খাতা আর মৌরির বাটি। উমা-আহার-সেন্টারে সকালের জলখাবার পাওয়া যায়; লুচি-তরকারি বা কচুরি-ডাল। পাওয়া যায় দুপুরের ও রাতের ভাত-মাছ-ডিম বা মুর্গির মাংস (পাঁঠার ঝোল পাওয়া যায় শনিবার রাত্রি ও রবিবার দুপুরে)। এ ছাড়া রাত্তিরে পাওয়া যায় রুটি ও ডিম বা প্লেন তড়কা (ঝাল, কম ঝাল, নো-ঝাল; তিন রকমের তড়কা মশলা পাওয়া যায়)। ওমলেট-টমলেটও পাওয়া যায়। এ হোটেলের কচুরি, মাছের ডিমের বড়া, ডিমের ঝোল আর তড়কার বিশেষ সুখ্যাতি রয়েছে।  উমাপদবাবুর ছেলে মিন্টু বাপকে বহুদিন ধরে বলে চলেছে সন্ধেবেলা এগরোল-চাউমিনের ব্যবস্থা রাখতে; কিন্তু উমাপদ রাজি হচ্ছেন না নতুন ‘প্রোডাক্ট’ চালু করবার ঝুঁকি নিতে।

শীতের বার বৃষ্টির রাত্রে মাঝে-সাঝে যেতাম উমা-আহার-সেন্টারে। রুটি-তড়কা ছাড়াও আলাপ হত উমাপদবাবুর হোটেলের নিয়মিত অতিথিদের সঙ্গে। ছাত্র, অল্প বয়েসি অবিবাহিত চাকুরের সংখ্যাই ছিল বেশি। তবে এদের মধ্যে একজন ছিলেন মাঝ বয়েসি এবং বাক্য বিলাসী; হরিদেববাবু। পাঁশকুড়োর লোক, এখানে একটি কারখানায় অ্যাকাউন্ট্‌স ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন। বাক্য-বিলাসী বললাম এ কারণে, খাওয়ার টেবিলে মজলিসি গপ্প জমাতে তাঁর কোনও জুড়ি ছিল না। তিব্বতের রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে কড়াইশুঁটির চমচমের রেসিপি; বৈচিত্র্যের অভাব ছিলনা।

এই হরিদেববাবুর আমার জীবনে একটি বড় অবদান আছে। উনি আমায় ‘স্ট্যাটাস’ শব্দের সঠিক উচ্চারণ শিখিয়েছিলেন।

বলেছিলেন , “ স্ট্যাটাস নয়। স্টেটাস বলবে এবার থেকে। স্ট্যা নয়, স্টে। কেমন? ইংরেজি পেট-রোগা’দের ভাষা নয়, স্মার্টলি বলার দরকার আছে। আর স্টেটাস ব্যাপারটা ন্যাচারাল নয় এটা মনে রাখবে। এটা গভীর ভাবে পলিটিক্যাল। খেলাটা চলে মগজের জটিল গলিতে”

উৎসুক হয়ে বলেছিলাম। “বুঝিয়ে বলুন”।

মিচকি হেসে হরিদেববাবু বলেছিলেন “দেখো, গত নয় বছর আছি আমি দুর্গাপুরে। আগাগোড়া একই মেসে থেকেছি আর এই উমা-আহার-সেন্টারেই রাতের খাওয়ার খেয়েছি। আমি এখানের চাকরিতে জয়েন করেছিলাম ক্লার্ক হিসেবে। মেস থেকে যখন রাত্রে উমা-আহার-সেন্টারের দিকে হাঁটা দিতাম, পথে কেউ যদি জিজ্ঞেস করতো কোথায় যাচ্ছেন তাকে বলতাম ‘ হোটেলে যাচ্ছি,  ভাত খেতে’। চার বছর পর আমার প্রোমোশন হয়; জুনিয়র এক্সেকিউটিভ হই আমি। তখন ওই একই প্রশ্নের উত্তর পাল্টে দিলাম, বলতাম ‘রেস্টুরেন্টে যাচ্ছি ডিনার করতে’। যদিও গন্তব্য এই উমা-আহার-সেন্টারই ছিল। কিন্তু সাব-কনশাস যে কোন ফাঁকে হোটেল বদলে রেস্টুরেন্ট আর ভাত বদলে ডিনার করে দিলে কে জানে। আবার দেখ গত হপ্তায় ফের প্রমোশন পেলাম। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার বনে গেলাম। গতকাল যখন উমা-আহার-সেন্টারের দিকে আসছি পথে দেখা প্রাক্তন মেস-বন্ধু বনমালীবাবুর সাথে। উনি জিজ্ঞেস করলেন কোথায় যাচ্ছি। আমার প্রমোটেড হৃদয় নিশ্চিন্তে জবাব দিলে ‘রেস্তোরাঁ থেকে সাপার্‌টা সেরে আসি’। তাই বলছিলাম বুঝলে, স্টেটাস ব্যাপারটা ভারি পলিটিক্যাল”  

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু