১
অনিন্দ্য নিজেকে
গোয়েন্দা বলতে বেশ লজ্জাই পায়। মাসে যে ক'টা কেস তার কাছে আসে, তা প্রায় সবই বিয়ের
আগে পাত্র-পাত্রী সম্বন্ধে গোপনে খোঁজখবর নেওয়ার জন্যে – পাত্রর মাইনে-কড়ি ঠিক কত,
পাত্রীর কোনও গোপন প্রেম রয়েছে কি না ইত্যাদি। তার তোপসে নেই, আছে শুধু তার ঘরের ও
অফিসের কাজের লোক কমল। তার কাছে যে এমন কেস কিভাবে এলো। ভাবতে ভালো যতটা না লাগছে,
তার চেয়ে বেশি লাগছে ভয়। দশ বছর হল এ লাইনে কাজ করছে অনিন্দ্য। তার এই সুপার শার্প
ডিটেকটিভ এজেন্সি পাত্রপাত্রী খবরাখবর জোগাড়ে বেশ নাম করেছে শহরে। কিন্তু তাই বলে
এমন জটিল কেস ? ডাইরেক্ট মূল্যবান সম্পদ চুরি ? এমন মক্কেল তার অফিসে আসলে কি
চায়ের সঙ্গে সামান্য টা’য়ের ব্যবস্থা রাখা উচিৎ ? কমলের সঙ্গে কনসাল্ট করতে হবে।
২
দীপক মিত্র’র চেহারা
দেখে বয়স চল্লিশের বেশি মনে হয় না। চেহারা ভারি ডাক-সাইটে, হীরের ব্যবসায়ীর চেহারা
এমনটাই হওয়া উচিৎ। গলার স্বর ঠিক বাজখাঁই নয়, তবে দম আছে। অনিন্দ্যর বেশ নার্ভাস
লাগছিল। কিন্তু দীপকবাবু যখন জানালেন যে চুরি হচ্ছে ‘কলকাতার শীত’, তখন অনিন্দ্যর
মালুম হল যে ভদ্রলোকের মাথায় ছিট রয়েছে। মানে মানে বিদেয় করতে হবে, এই ভেবে কমলকে
সে ইশারা করলে যে চায়ের সাথে ফুলুরি ভাজার দরকার নেই।
৩
অনিন্দ্য – চুরি যে
হয়েছে, সেইটা আপনি কি করে বুঝলেন ?
দীপক – নিজের চোখে লোপাট
হতে দেখছি তো।
অনিন্দ্য – আমি যদি
আপনাকে পাগল বা বেয়াদব ভাবি তাহলে কি খুব অন্যায় হবে?
দীপক – না। লাল-বাজার
বা অন্যান্য জায়গাতেও তাই বলেছে। তাই বাধ্য হয়ে আপনার কাছে এসেছি। আই উইল অফার ইউ
টেন থাউজ্যান্ড যদি আপনি কেসটা নেন। যদি চোরকে কে বামাল ধরতে পারেন, আই উইল গিভ ইউ
আ ল্যাক।
অনিন্দ্য – দশ হাজার
টাকার আমার খুব দরকার। কেস নেব।
দীপক – এই খামে দশটা
হাজার টাকার নোট আছে।
অনিন্দ্য – গুনে নিলাম
বলে কিছু মনে করবেন না। হয়ত আপনার মাথার ছিটের সুযোগ নেওয়াটা অন্যায় হচ্ছে...।
দীপক – ইট ইজ ওকে।
বালিগঞ্জ প্লেসে, রাস্তার ধার ঘেঁষা একটা ঘুমটি চায়ের দোকানে ওরা এসে প্ল্যান করে
রোজ। ওই দোকানটাই ওদের কন্ট্রোল রুম। কলকাতার শীত-চুরির ব্লু-প্রিন্ট ওখানেই তৈরি
হয়েছে।
অনিন্দ্য – এইটে মনে
হওয়ার কারণ ?
দীপক - আমার কানে
এসেছে। হরিপদ আর কালু; ওদের প্ল্যান আমি শুনে নিয়েছি। লেরো খেতে গেছিলাম। আমার কান
ভারি শার্প।
অনিন্দ্য – হরিপদ কে
? কালু কে ? ওরা কলকাতার শীতকে চুরি করতে চাইবে কেন ? আর ইয়ে, মানে আমি বুঝতে পারছি
না আপনি এমন দড়কচা লেভেলের গুল কেন মারছেন ?
দীপক – আপনি টেন
থাউজ্যান্ড রিফিউজ করছেন ?
অনিন্দ্য – না! সে
ক্ষমতা আমার নেই।
দীপক – হরিপদ’র বয়স
ষাটের বেশি। ওই চায়ের দোকানের মালিক। ওর ছেলে কালু। এই চিরকুটে ওদের দোকানের
এগজ্যাক্ট ঠিকানা আছে। আপনি আমায় কবে রিপোর্ট করছেন ?
অনিন্দ্য – ঠিক দু'দিন পরে।
হরিপদ আর কালুর জীবন-পঞ্জি
বার করে পাগলটার হাতে তুলে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। কেস জলবৎ অনিন্দ্যর কাছে।
৪
গড়বড়। অনিন্দ্য বেনামি
হুমকি চিঠি পেয়েছে যাতে সে এই কেস না নেয়। কেউ তার বসবার ঘরে চিঠিটা মুড়ে ছুঁড়ে
ফেলেছিল। কিন্তু বড় কথা হচ্ছে, দীপকবাবু আচমকা নিখোঁজ। বাড়ির লোক ক্লু-লেস। পকেটে
গরম দশ হাজার সত্ত্বেও অনিন্দ্য বেশ ফাঁপরে পরে গেল।
৫
এই তিনদিনে হরিপদ’র
যথেষ্ট খবর অনিন্দ্য জোগাড় করেছে। বা জোগাড় করার চেষ্টা করেছে। এবং তার মাথা ঘোরার
যথেষ্ট কারণ আছে। কারণ অনিন্দ্য সান্যাল, যে কিনা বারুইপুরের পাত্রের সাত পুরুষের
খবর মাত্র দেড় দিনে জোগাড় করে ফেলে, সে হরিপদ’র বাড়ির ঠিকানা মালুম করতে পারলে না।
এই তিনদিনে রোজই হরিপদ দোকান বন্ধ করবার পর তার পিছু নিয়েছে অনিন্দ্য। কিন্তু
কোথায় কখন যে হরিপদ মিলিয়ে যায়।
৬
হরিপদ – আপনাকে কিডন্যাপ করতে ভীষণ খারাপ লেগেছে।
অনিন্দ্য – কিন্তু
করলেন কেন ?
হরিপদ – কারণ শহরের
শীত চুরি হওয়ার মত এমন একটা ফালতু খবরের পিছনে আপনি দৌড় শুরু করেছিলেন।
অনিন্দ্য – দীপকবাবুকে...?
হরিপদ – ইয়েস স্যার,
আমিই কিডন্যাপ করেছি।
অনিন্দ্য- এমন
পাগলামিকে কেন্দ্র করে আপনি দুজনকে কিডন্যাপ করলেন। এটা পাগলামি নয় ?
হরিপদ – শুধু কিডিন্যাপটাই
দেখলেন ? আজ যে আপনাদের দুজনকেই খুন করব, সেটার ব্যাপারে কিছু বলবেন না?
অনিন্দ্য – আপনি উন্মাদ
হরিপদবাবু।
হরিপদ – আমি উন্মাদ
নই। আর আপনার সন্দেহ ঠিক অনিন্দ্যবাবু। আমি হরিপদও নই। আমার নাম আপনি উচ্চারণও
করতে পারবেন না। তবে আমায় ভালোবেসে প্রি-সু বলতে পারেন। আমি অবভিয়াসলি দেখতেও এমন
নই। ছদ্মবেশ। গত তিরিশ বছরের ধরে চা ওয়ালা হয়ে আপনাদের শহরে ঘুরঘুর করছি। তিরিশ বছর অবিশ্যি আপনাদের গ্রহের বছরের হিসেবে। আর প্রতি
বছর নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি, আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রি-স্রে বা আপনাদের পরিচিত
কালুর সাথে মিলে, আপনাদের কলকাতার শীতের আমেজ চুরি করি। চুরি করে সেই আমেজ কে
ডিজিটাল এলগোরিদমে কনভার্ট করে আমাদের গ্রহ পেঞ্চুয়ারিতে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
অনিন্দ্য –
সাইবেরিয়া থাকতে আপনি কোলকাতা এলেন শীত চুরি করতে ?
হরিপদ – দেখুন
অনিন্দ্যবাবু। আবহাওয়া ও আবহাওয়ার আমেজ চুরি এবং সেই চুরি করা আবহাওয়ায় নিজেদের
গ্রহ সাজিয়ে তুলতে আমরা শিখি আজ থেকে শ'খানেক বছর আগে । ইয়েস, আমাদের গ্রহের
পরিবেশ আর প্ল্যানেটারি মোশনের কেনা গোলাম নয়। তারপর আমরা দু'শো বাহাত্তরটা এমন
গ্রহ জুড়ে জরীপ করেছি যাঁদের পরিবেশ মনোরম। এই সব গ্রহের পনেরো লক্ষ অঞ্চল আমরা
ঘুরে বেরিয়েছি আদর্শ আবহাওয়ার খোঁজে। কিন্তু গড় বারো ডিগ্রী তাপমানের এমন মধুর
মেজাজ, এমন নলেন গুড়, এমন ময়দানের শীতের বিকেলের মধু, এমন মাঙ্কি টুপির আদুরে-পনা,
এমন লেপের মিঠে ওম, এমন ফুলকপির শিঙ্গাড়ার আবেশ; আমরা আর কোথাও পাইনি
অনিন্দ্যবাবু। পেঞ্চুয়ারি ভীষণ ছোট গ্রহ। কোলকাতা থেকে শীত চুরি করেই আমাদের
সম্পূর্ণ গ্রহের পরিবেশ গোটা বছরের জন্যে মনোরম করে রাখা যায়।
অনিন্দ্য – আমার কিস্যু
বিশ্বাস হচ্ছে না...আপনি...আপনি...
হরিপদ – অত নার্ভাস
হবেন না অনিন্দ্যবাবু। খুন করার কথাটা আমি ঠাট্টা করে বলেছি। আমাদের সামান্য
অসতর্কতায় এই যে দীপকবাবু আর আপনি আমাদের প্ল্যান-প্রোগ্রামের ব্যাপারে সন্দিহান
হয়েছেন, তাতে আমাদের ভারি অসুবিধে। আমরা শুধু আপনাদের দুজনের ব্রেন থেকে এই কদিনের
স্মৃতি একদম মুছে ফেলবো। সেই টেকনোলজি আমাদের আছে। সামান্য তো শীত-চুরি, তাই নিয়ে
এত মাথা ব্যথার কারণটাই বা কি অনিন্দ্যবাবু ?
৭
আচমকা এই দশটা হাজার
টাকার নোট সমেত এই খামটা তার দেরাজে কি করে এলো, তা কিছুতেই মনে করতে পারছিল না অনিন্দ্য।
এদিকে কমলকে জিজ্ঞেস করাও সমীচীন মনে হচ্ছে না।তাই বলে দশটি হাজার টাকা আচমকা তার
দেরাজে, দুশ্চিন্তায় পড়তে হল অনিন্দ্যকে।
Comments