বালিগঞ্জ ফাঁড়ির মুখে ছুটে ট্রামে উঠতে গিয়ে গড়বড় করলেন আশুতোষ। পা ফসকে
পপাত চ। সন্ধ্যের ভিড়, বাস-ট্যাক্সিতে মাখা-মাখি রাস্তা, সাই সাই করে অটোরিকশা
ছুটছে; পা ফসকে ট্রামের চাকার তলায় যাবেন না মিনিবাসের টায়ার জুটবে এসব ভাবতে
ভাবতেই ধপাৎ করে পড়লেন কাঠের মেঝেতে!
কি মুস্কিল। বালিগঞ্জ ফাঁড়ির পিচের রাস্তা হয়ে গেল হলদে কাঠের মেঝে ?
আশেপাশে তাকিয়ে আশুতোষ দেখলেন ঘন চাপ চাপ অন্ধকার। কিছুই তেমন দেখা যায় না। এ যে
ভোজবাজি। ছিলেন কলকাতায় আর এলেন এ কোথায় ? তবে কি তিনি মারা গেছেন ? পেছন থেকে বাস
এসে তার মাথা চটকে দিয়ে গেছে ? কি চাপ। বেয়াল্লিশে মারা গেলে তেমন ক্ষতি ছিল না,
কিন্তু এল-আই-সি’টা আগামী মাসে ম্যাচিওর করছিল। গিন্নী সব কিছু ঠিকঠাক ম্যানেজ
করতে পারলে হয়।
টের পেলেন কোমরে চিনচিন ব্যথা হচ্ছে। মরে গেলে কি ব্যথা-ট্যাথা হওয়া উচিৎ
ছিল ? মহা-মুশকিল। গায়ে রক্ত-টক্ত লেগে নেই, আত্মার গায়ে রক্ত লাগা
উচিৎও নয়। কিন্তু আশুতোষবাবু অবাক হলেন এই ভেবে যে পরলোকের চেহারা এত ম্যাড়ম্যাড়ে
কেন ? স্বর্গ-সুলভ জেল্লা নেই, নরক-গোছের হ্যঁচড়-প্যাঁচর নেই। শুধু এই
হলদে কাঠের মেঝে।
অন্ধকারে চোখ একটু থিতু হতে আশুতোষ টের পেলেন যে মেঝে জুড়ে রকমারি
জিনিষপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। চিরুনি, মানিব্যাগ, বর্শা, সিনেমার টিকিট, কলম, হামানদিস্তা;
কি নেই সেখানে। প্রবল ঘাবড়ে গেলেন আশুতোষ। তবে কি স্বপ্ন ? নিজেকে চিমটি কাটলেন। ছেলেবেলায় ভদ্রেস্বরের
বেণুমামার থেকে রাম-চিমটি কাটা শিখেছিলেন। ব্যথায় ককিয়ে উঠলেন তিনি। লে হালুয়া।
আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন আশুতোষ। হেঁটে জায়গাটা একটু দেখে নেওয়া দরকার।
কিন্তু হাঁটবেন কি, মেঝেময় মাল-পত্তর; বই, ছিপি, পুরনো ইনল্যান্ড লেটার, সিগারেট,
টনিক কত কি। মহা-অস্বস্তিতে পড়া গেল।
-“ নতুন মনে হচ্ছে ?”
পাতলা কণ্ঠস্বরের হাঁক শুনে বেদম ভেবড়ে গেলেন আশুতোষ। পিছনে তাকাতেই
দেখলেন, এক জরাজীর্ণ চেহারার বৃদ্ধ হাত পাঁচেকের মধ্যে শুয়ে আছেন, গায়ে কম্বল
টানা। বয়সের গাছ-পাথর আছে বলে মনে হল না; নব্বই হলেও হতে পারে। চেহারা বলতে হাড়ের
ওপর হলদে চামড়া, মাতায় চুল-টুল কিস্যু নেই। ঘোলাটে চোখ, তোবড়ানো গাল। প্রায়
কাঁপছেন মনে হল।
-
“ বলি নাম কি ?”, বৃদ্ধ ফের শুধলেন।
-
“আজ্ঞে আশুতোষ মিত্র। পার্ক
সার্কাস যাওয়ার জন্যে ট্রাম ধরতে গিয়ে পা ফসকে যে এখানে কি করে এসে পড়লাম...আপনি
কে ? এই জায়গাটা কোথায় ?
-
অন্য ডাইমেনশন।
-
আজ্ঞে ?
-
অন্য ডাইমেনশন।
-
সেটা কি ?
-
মানে। টু ডাইমেনশন। অমুক
ডাইমেনশন। তমুক ডাইমেনশন। সময়ের ডাইমেনশন। ওসব বাদে। এ অন্য ডাইমেনশন।
-
আজ্ঞে?
-
উফ, কি মুশকিল। ধর একটা
পেন তুমি টেবিলে রাখলে। আর দু মিনিট পর সেই টেবিল তন্নতন্ন করে খুঁজেও সে পেনের টিকিটির
দেখাও তুমি পেলে না। আবার আধ ঘণ্টা পর এসে দেখলে সেই টেবিলের ওপরেই পেনটা রয়েছে। এমন
কি আকচার হয় না ?
-
আজ্ঞে হয়।
-
তো ব্যাপার হল, আমরা পৃথিবীতে
যে ডাইমেনশনে বাস করি, সেখান থেকে জিনিষপত্র হামেশাই ফসকে এই অন্য ডাইমেনশনে চলে
আসছে। প্রকৃতির এক্সেপশন কাম এরর্ বলতে পার।
-
প্রকৃতির ভুল ?
-
রাইট ইউ আর। বেশির ভাগ
সময়েই সেই ভুল প্রকৃতির নিয়মেই শুধরে যায়। তাই সেই হারানো পেনটাও ঠিক টেবিলে ফেরত
চলে যায়। আচমকা যে জিনিষ অপ্রত্যাশিত ভাবে হারায়, তা আবার অপ্রত্যাশিত ভাবেই ফেরতও
আসে। কিন্তু কখনও-সখনও আবার তারা অনন্ত কাল ধরে এই অন্য ডাইমেনশনে আটকে থাকে।
-
গলা শুকিয়ে আসছে যে।
-
চিন্তা নেই। ওই গলা
শুকিয়ে আসা তোমার মনের ভুল। এই অন্য ডাইমেনশনে ক্ষুধা-তৃষ্ণার মত পাতি ব্যাপারগুলো
ফসকে আসে না। রোগ-ভোগও তেমন নেই। নয়তো কি আর আমি এই একশো পনেরো বছরেরও বেশি দিব্যি বেঁচে থাকি ?
-
ইয়ে, আপনিও পৃথিবী থেকে ফসকে
এই অন্য ডাইমেনশনে চলে এসেছেন ?
-
ইয়েস, এসেছি। অবিশ্যি
জ্যান্ত কেউ খুব একটা এই অন্য ডাইমেনশনে আসে না, তাঁদের ডাইমেনশনাল ইকুইলিব্রিয়াম অনেক
বেশি। কখনও সখনও চলে আসে, বিশেষ করে কোনও প্রাণী যখন ওপর থেকে নিচে ছিটকে পড়ে, সে
সময় একটা খুব সূক্ষ্ম চান্স থাকে। গত আশি বছরে আমি ছ-সাত জনের বেশি মানুষকে এদিকে
আসতে দেখিনি। তবে তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ফেরত চলে গেছে অরিজিনাল ডাইমেনশনে, কেউ
দু চার মিনিটে, কেউ বা দু চার সেকেন্ডে।
-
আর আপনি ? আপনি রয়ে
গেলেন ?
-
হে:, তা আর কি করা যাবে।
ডেস্টিনি। আমার অরিজিনাল ডাইমেনশন ঘিরে অনেক স্বপ্ন ছিল। সব গোল্লায় গেল। এমন
এক্সেপশন বিশেষ হয় না। কি আর করা যাবে বল। আমি জন্ম থেকেই আশাবাদী। কিন্তু মুশকিল
হচ্ছে এই অন্য ডাইমেনশনে অপ্টিমিজ্ম বেশ গুরুত্বহীন।
-
ইয়ে স্যার, আপনি এলেন কি
ভাবে ? মানে আমি যেমন ট্রামে উঠতে গিয়ে পা ফসকে...
-
এয়ার ক্র্যাশ। জ্বলন্ত
প্লেন থেকে বেশ হিসেব করে ঝাঁপ দিয়েছিলাম প্লেন গ্রাউন্ড হিট করার কয়েক সেকেন্ড
আগে। বাঁচার সুযোগ ছিলই। কিন্তু কেষ্ট মারলে রাখবে কে ? সোজা এসে ল্যান্ড করলাম এই
হলুদ কাঠের মেঝেতে।
-
এটা কবে ঘটে ? কোথায় ?
-
ফরটি ফাইভে বোধ হয়।
সায়গন থেকে মাঞ্চুরিয়া যাচ্ছিলাম। ফরমোসা’র
ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় আচমকা প্লেনটা বেসামাল হয়ে যায়...
-
আআআআ...আপনি....আপনি...
-
সুভাষ...সুভাষ
বোস...
-
নে...নে...নে...
~~
মুখে জলের ঝাপটা পড়তে চোখ খুললেন আশুতোষ। টের পেলেন যে তিনি বালিগঞ্জ
ফাঁড়ির পাশের ফুটপাথে টানটান শুয়ে, তাকে
ঘিরে অন্তত জনা দশেক লোক। যে ভদ্রলোক তাঁর নাড়ি টিপে বসে, তিনিই বললেন ;
-
“ খুব জোর বেঁচে গিয়েছেন
মশাই”
আপ্লুত আশুতোষ বলে উঠলেন; “ জয় হিন্দ” ।
Comments