Skip to main content

গ্যাংটক ও হালুয়ামোহন



গ্যাংটকে গণ্ডগোল সম্বন্ধে দু'টো মাইনর আর একটা মেজর বক্তব্য।

**
মাইনর-এক।

বাদশাহী আংটির তরুণ তুর্কী মেজাজ ছেড়ে ফেলু এখানে বেশ পোড় খাওয়া গোয়েন্দা। পকেটে রিভলভার নিয়ে ঘুরছে। অবশ্য এর মাঝে সে সে কৈলাস চৌধুরীর পাথরে কেস আর শেয়াল দেবতার রহস্য সলভ করেছে। তাছাড়া এ গল্পটার মধ্যে ট্যুইস্ট অ্যান্ড টার্নগুলো রীতিমত সিনেম্যাটিক।  গ্যাংটকের পটভূমিটাও দিব্যি এক্সপ্লোর করা হয়েছে; পাহাড়ের গা দিয়ে গড়িয়ে ফেলা পাথর, মনাস্ট্রি বিষয়ক মিস্ট্রি, পাহাড়ি লোডশেডিংয়ে গা-কাঁপানো প্ল্যানচেট আর একটা 'হাইভোল্টেজস্পার্ক' ক্লাইম্যাক্স। 

**

মাইনর-দুই।

শুনেছি বিজ্ঞাপনে subliminal messaging  ব্যাপারটা প্রায় অস্ত্রের মত ব্যবহৃত হয়। আমি তেমন বুঝিটুঝি না তবে আমাদের বহু বাজারু বদ-অভ্যাস যে এই সাবলিমিনাল মেসেজিংয়ে ঘায়েল হয়ে তৈরি হয়েছে, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত।  তেমনই, ঝাঁ-চকচকে সুরসিক বাঙালি কেমন হবে তা নিয়ে সত্যজিৎবাবু ফেলুকে ব্যবহার করে আমাদের অজান্তেই আমাদের সাবকনশাসে কিছু ঘুঁটি সাজিতে গেছেন৷ একটা লাইন কোট করি যা এমনিতে তেমন নজরকাড়া কিছু নয় কিন্তু সে'সব লাইনের সামগ্রিক ইনফ্লুয়েন্স বেশ কয়েকটা প্রজন্ম বয়ে বেড়াচ্ছে;

"ফেলুদা মাঝেমধ্যে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল; কেন সেটা বুঝতে পারলাম না। হয়তো মনের মধ্যে কোনও খটকা রয়েছে। এত ভালো মাংস খাওয়ার সময়ও তার চোখ থেকে ভ্রূকুটি যেতে চাইছে না"।

**
মেজর।

এ'বার আসি মোক্ষম ব্যাপারটায়। এ'টা অবশ্যই অন্ধকারে ঢিল। তবু বলি। এই গল্পেই বোধ হয় লালমোহন গাঙ্গুলির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। নিশিকান্তবাবুই সম্ভবত সত্যজিতের প্রথম চেষ্টা ফেলু-তোপসের সঙ্গে একজন মজারু আর মাইডিয়ার থার্ড হুইল জুড়ে দেওয়ার। নিশিকান্তবাবু লালমোহনের মতই আন্তরিক, বিপদে নার্ভাস হলেও ঝুলে পড়ার লোভ সামলাতে পারেন না। 
কোট করি;
"নিশিকান্তবাবু ফেলুদার মুখে সমস্ত ঘটনা শুনে একটু ঘাবড়েছেন বটে, তবে ভিতরে ভিতরে মনে হল অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধটা পেয়ে তিনি বেশ একটা রোমাঞ্চ বোধ করছেন। নামচির বাজার থেকে একটা কমলালেবু কিনে খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বললেন, 'বিপদ যাই আসুক না কেন মশাই, একদিকে প্রদোষবাবু আর একদিকে জার্মান বীরেনবাবুকে নিয়ে ডরাবার কোনও কারণ দেখছি না'।" মাঝেমধ্যেই তিনি লালমোহনীয় সুরে "বেশ থ্রি- মানে থ্রিলিং লাগছে"ও বলে উঠছেন। উপন্যাসের শেষও তাঁর কথা দিয়েই; "থ্যা-মানে থ্যাঙ্কস"।

এর সঙ্গে যোগ করা যাক ওঁর অস্ত্রের প্রতি ঝোঁক, এ ক্ষেত্রে ছিল জোঁক ছাড়ানোর বিশেষ লাঠি। প্যাকেজ সম্পূর্ণ করতে ভদ্রলোককে একটা বাটারফ্লাই গোঁফও পরিয়ে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ।  সব মিলে জম্পেশ লালুবাবু মেটেরিয়াল।

 নিশিকান্ত সরকারকে নিয়ে এগোনো গেলনা কারণ তিনি দার্জিলিংয়ের মানুষ, ফেলুর বাড়ি নিয়মিত শিঙাড়া পৌঁছে দেওয়ার জন্য গড়পাড়ের মানুষই সুবিধেজনক।  তা'ছাড়া রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজের লেখক হিসেবে লালুবাবু অনেক বেশি মশলা এনে দিয়েছেন। আর একটা বড় ব্যাপার; নিশিকান্তবাবুর টাকার লোভ রয়েছে এবং তার জন্য এথিকস ব্যাপারটাকে মাঝেমধ্যে চেপেচুপে রাখতে তাঁর তেমন আপত্তি নেই৷ কিন্তু ফেলুদার বন্ধু হতে গেলে সে ব্যাপারে কম্প্রোমাইজ যে কিছুতেই চলবে না তা বলাই বাহুল্য।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু