Skip to main content

দু'জন

প্রথম দৃশ্য

সকালের শশব্যস্ত ফুটপাথ। জায়গাটা ঢাকুরিয়া হতে পারে, টালিগঞ্জ হলেও কিছু আটকাবে না।
এক ভদ্রলোক একটা ঠেলার পাশে দাঁড়িয়ে ঘুগনির স্টিলের প্লেট চেটে সাফ করছিলেন।বয়স এই তেত্রিশ চৌত্রিশ। গালে খোঁচা দাড়ি, নাক দৃষ্টিকটু ভাবে বাঁকা,  কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, পরনে হালকা নীল হাফ শার্ট আর খয়েরী ট্রাউজার। পায়ে চামড়ার চটি।এমন সময় পিঠে একটা হালকা টোকা পেতে ভদ্রলোক ফিরে তাকালেন।

পিছন ফিরতেই দেখলেন সেই ভদ্রলোককে।বয়স এই তেত্রিশ চৌত্রিশ। করছিলেন।বয়স এই তেত্রিশ চৌত্রিশ। গালে খোঁচা দাড়ি, নাক দৃষ্টিকটু ভাবে বাঁকা,  কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, পরনে হালকা নীল হাফ শার্ট আর খয়েরী ট্রাউজার। পায়ে চামড়ার চটি। মুখের মিলটাও চোখে পড়ার মত, তবে সম্ভবত অবিকল নয়।   



দ্বিতীয় দৃশ্য

শহরের কোন একটা পার্ক। দেশপ্রিয় হতে পারে, অন্যকিছুও। একটা বেঞ্চি; কাঠের না হয়ে লোহার হওয়াই ভালো।
দুই ভদ্রলোক পাশাপাশি বসে।
-   দিলেন তো অফিসটা মাটি করে। ধুস!
-   কী আশ্চর্য! আপনিও তো আমার অফিস মাটি করলেন।
-   আরে আমার অনেক কাজ ছিল।
-   আমায় দেখে মনে হয় আমি ফাঁকিবাজ? আমি অফিসে ঘুমোই?
-   না। আপনাকে দেখে আমার মতই মনে হয়।
-   সে’টাই তো সমস্যা। বাস সিগনালে দাঁড়িয়ে আর আমি বাসের জানালায়, হাতে আনন্দবাজার। ফুটপাথের দিকে নজর যেতেই বুকে ধড়াস। দেখলাম আমি ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ঘুগনির প্লেট চাটছি। দু’সেকেন্ড পরে বুঝলাম, আমি বাসেই। ঘুগনির আমি আমি না। তাই হুড়মুড় করে নেমে এলাম।
-   অসোয়াস্তি অন্য জায়গায়।
-   কোন জায়গায়?
-   জামা কাপড় চটির এমন ভাবে মিলে যাওয়া। আচ্ছা, আপনার পকেটে রুমাল আছে?
*পাশের ভদ্রলোক পকেট থেকে কালচে নীল রুমাল বের করলেন*
*দীর্ঘশ্বাস ফেলে অপর ভদ্রলোক নিজের রুমাল বের করে অন্যজনের সামনে মেলে ধরলেন, অবিকল এক কালচে নীল রুমাল*।
- আচ্ছা, আপনার মানি ব্যাগে কত আছে?
- আমার মানিব্যাগে?
- কত আছে?
*মানিব্যাগ বের করে গোনা শুরু*
- ছ’শো বত্রিশ। আপনার কাছে?
*মানিব্যাগ বের করে গোনা শুরু*
- আহ্‌! যাক। এগারোশ বত্রিশ। আমার কাছে। যাক। তাহলে সব মিলে যায়নি। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো মশাই। তাহলে...ওঠা যাক।
- এক্সকিউজ মি ঘুগনীবাবু।
- কী হল?
- আমি একটু কশাস।
- তো?
- মানে আমার প্যান্টের একটা চোরা পকেট আছে। ওখানে আমি সিকুইরিটি মানি রাখি। *নিজেকে আড়াল করে প্যান্টের গোপন অঞ্চলে হাত চোরা পকেট হাতড়ানো আর বের করে আনা একটা পাঁচশো টাকার নোট*। ছ’শো বত্রিশ প্লাস পাঁচশো। টোটাল এগারোশো বত্রিশ।
*অন্য ভদ্রলোকের ধপ্‌ করে বসে পড়া*
- যাহ্‌ শালা!
- অদ্ভুত। তাই না?
- আপনার মোবাইলটাও দেখলাম নকিয়ার। পুরনো মডেল।
- এগারোশো। মডেল নাম্বার।
- না বললেও হত। আমারটাও তাই।
- আমার কিন্তু দিব্যি লাগছে জানেন!
- কচু দিব্যি! অসোয়াস্তি হচ্ছে না?
- তা ঠিক না। তবে অবাক লাগছে। ফ্যান্টাস্টিক ব্যাপার। আচ্ছা আপনার বাড়িতে কে আছে?
- আমি একা। আপনারও তাই কেস নিশ্চই? বাপ মা অল্প বয়েসে হাওয়া? মামার কাছে মানুষ? বিয়ে থা করা হয়নি?
- কে বললে? বাড়িতে বাবা, মা, ছোটবোন, মেয়ে বাবলি ক্লাস টু তে পড়ছে, দিব্যি রাইম্‌স বলছে।
- ওহ! যাক।



তৃতীয় দৃশ্য

পাড়া। বিকেলের পরিচিত ইতিউতি শব্দ ভেসে বেড়াচ্ছে চারদিকে। এক ভদ্রলোক একটা সরু সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছিলেন। বয়স এই তেত্রিশ চৌত্রিশ। গালে খোঁচা দাড়ি, নাক সামান্য  কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, পরনে হালকা নীল হাফ শার্ট আর খয়েরী ট্রাউজার। পায়ে চামড়ার চটি।
একটা বছর পাঁচেকের মেয়ে হুড়মুড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে জড়িয়ে ধরবে ভদ্রলোককে।
-   বাবা, তোমার অফিস আজ তাড়াতাড়ি ছুটি হল?
-   হল।
-   তুমি আমার জন্যে নতুন পেন্সিল বক্স আনোনি?
-   এ বাবা! নাহ্‌!
-   তুমি বলেছিলে আনবে।
-   একদম ভুলে গেছি। কাল ঠিক আনবো দেখিস।
-   ভুলবে না তো?
-   কদম নাতোর মা কোথায় রে বাবলি?



চতুর্থ দৃশ্য

শোওয়ার ঘর। বাবলি নামক মেয়েটা চওড়া বিছানার এক কোণে ঘুমিয়ে কাদা।
ভদ্রলোক খাটের এক কোণে বসে। ভদ্রমহিলা ঘরের অন্যপ্রান্তে। জানালার শিকে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে। বয়স ছাব্বিশ কি সাতাশ, মুখে শ্রান্তি, বিহ্বলতা। চোখ অস্বস্তিকর ভাবে স্থির। পরনে হলদে ছাপার শাড়ি, সবুজ ব্লাউজ।
ভদ্রলোক সামান্য কেশে বলতে শুরু করলেন;
-   তুমি গত এক ঘণ্টায় কিছুই বলোনি মিনু।
-   আমায় মিনু বলে ডাকবেন না দয়া করে। তুমিও বলবেন না। আপনি ও নন।
-   আমি সরি বলেছি।
-   এ’টা সরি বলার মত ঘটনা? আমাদের জীবন শেষ করে দিয়ে বলছেন সরি?
-   আসলে আমি চিরকালের একলা। তার মধ্যে ভদ্রলোকের সাথে মিলগুলো দেখে এমন ভেবড়ে গেছিলাম যে মাথা কাজ করছিল না। আচমকা এই ভরা সংসারের গল্প শুনে ঠিক...মানে...মাথায় কী যে হলো! আমি খুন করতে চাইনি।
-   কিন্তু করেছেন। আমার বরকে খুন করেছেন। আর সে’টা আমাদের বিছানায় বসে আমায় জানাচ্ছেন।
-   আমি সংসারটা ম্যানেজ করে নেব মিনু। এই খুনটা ভুলের, কিন্তু কেই কিচ্ছুটি টের পাবে না।বাবা,মা এমনিতেই বয়সে অথর্ব।বাবলি সোনার এইটুকু বয়স... আমি সব...।
-   প্লিজ আমায় ও নামে ডাকবেন না। ওঁদের বাবা মা বলে ছোট করবেন না। বাবলিকে সোনা বলবেন না।
-   আমি ম্যানেজ করে নেব।
-   আপনি কি মানুষ?



পঞ্চম দৃশ্য

মিনু টিফিনবাক্স রেডি করে অফিসের ব্যাগে ভরছিল। ভদ্রলোক জড়সড় হয়ে এক কোণে দাঁড়িয়ে। পরনে আকাশী কালো চেক হাফ শার্ট আর কালো প্যান্ট।
অসোয়াস্তি কাটিয়ে মিনু বললে;
-   টিফিনে আজ নিরামিষ। সকালে তো আর বাজার গেলে না। আর ফেরার পথে আজ বাবলির পেন্সিল বাক্সটা আনতে ভুলো না। গতকাল মেয়েটা খুব দুঃখ পেয়েছিল। কেমন?  


ষষ্ঠ দৃশ্য

অফিস টাইমের শহর। চারপাশে ভিড় আর ঘামে হাঁসফাঁস অবস্থা। শহরের হুড়মুড়ে ব্যস্ততা এ সময়ে যেন কানের মধ্যে একটানা গিজগিজ করে চলে।
ফুটপাথের এক পাশ আলো করে দাঁড়ানো ঘুগনি পাউরুটির ঠেলাটার পাশে দাঁড়িয়ে; আকাশী কালো চেক হাফ শার্ট আর কালো প্যান্টে পরা ভদ্রলোক দিব্যি ঘুগনির প্লেটে লাগা ঝোলের শেষ রেশটুকু জিভে মাখিয়ে নিচ্ছিলেন।
প্লেটের বিটনুন লেবু ছোঁয়ানো অন্তিম পেঁয়াজ কুচিটুকু চেটে নেওয়া মাত্রই চোখ গেল লাল সিগন্যালে দাঁড়ানো মিনিবাসটার দিকে। অসহ্য বুকের ধড়ফড়ের মধ্যেও বাসের দরজায় বাদুড় ঝোলা হয়ে থাকা লোকটার আকাশী কালো চেক হাফ শার্ট আর কালো প্যান্ট চিনতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হল না তার।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু