Friday, July 29, 2016

রাজার দুঃখ

ঝড় মাথায় করে উঠে দাঁড়ালেন রাজা। থুড়ি। ঠিক দাঁড়ানো নয়, ব্যাপারটা ওড়া আর ভাসার মাঝামাঝি। রাজা আলগা করে দিলেন মনের যত ছিটকিনিগুলো। আহ! বড়ই যন্ত্রণা। এত কিছু হলো, তবু যন্ত্রণা উড়ে গেলো না। 

খানিকক্ষণ বাতাসে পতপত করে ওড়ার পর একটা তালগাছের মাথায় ঠেকে খানিক ফোঁস করলেন তিনি। 

রাজা বলে কথা। রাজার দায়িত্ব কি কম? প্রজাপালন, দেশের ভালো, দশের ভালো, দশের ভালোবাসা, দশের মঙ্গল। 
আহা! এহেন রাজার কি দু'দণ্ড জিরিয়ে নেওয়ার যো আছে ভাই? কত কাজ তার! কত মন ভালো করা কাজ আছে রাজার হাতে। নাওয়াখাওয়ার সময় থাকবে না; নজরে শুধু এর ভালো আর ওর ভালো! তবেই না রাজা! তবেই না রাজার মত রাজা!

তালগাছের মাথায় হাওয়া সামান্য বেশি, বাতাসের ভেজা ভাব সামান্য কম। অন্ধকারে নরমের ছ্যাঁত আরও বেশি। এ পরিবেশে চিন্তার দল পরিপুষ্ট হয় আর রাজার বুকের ভার টুপটাপ বেড়ে চলে। বেড়ে চলে আফসোস। 

"এ কী করেছি আমি? এ কী করেছি?", রাজার ছটফটানিতে তালগাছ মুচড়ে ওঠে। 

**
- আপনিই আমাদের নতুন রাজামশাই?
- হ্যাঁ। আপনি ঝাও?
-  আজ্ঞে। আমিই। 
- ইয়ে, ঝাও ব্যাপারটা ঠিক কী? বলবেন একটু বুঝিয়ে?
- আমরা! মানে ভূতেরা নিজেদের কোবরেজদের ঝাও বলি। ঝ্যাঁটাপেটানো ওঝাদের এগজ্যাক্ট অপোজিট। তা ইয়ে, মানুষের কোবরেজ তো আর আপনার কাজে লাগবে না রাজামশাই। এখন শুধু আমাদের টোটকা!
- ঝাওবাবু। আমায় বাঁচান!
- সে কী মহারাজ! মরে তবেই না আপনি ভূতের রাজা হয়েছেন! আপনাকে বাঁচাবো কী করে? আপনি তো মড়া! আমাদের মতই। 
- না মানে ইয়ে...মানে...ঝাওবাবু...।
- বলুন রাজন!
- বড় পাপের যন্ত্রণা।
- পাপ?
- পাপের ডিপো যে আমি। তালগাছের মাথায় ফেকলু ভাবে বসে ঠ্যাং দোলাচ্ছি বলে ভাববেন না যে চিরকালই আমি এমন সরল ছিলাম। ভাববেন না যে আমি চিরকালই এমন পরোপকারী রাজা ছিলাম।
- এ কী বলছেন মহারাজ? ভূত জগতে আপনার কত সুনাম, কত সম্মান। ভূতদের কত অসুবিধের হিল্লে হয়ে গেলো আপনি রাজা হওয়ার পর থেকে। সবার বাসায় শ্মশানের ছাই, সবার হাতে মড়ার হাড়, সব স্কন্ধকাটার কাছে মাফলার! সবাই খনাসঙ্গীতে আপনার গুণগানে ব্যস্ত। 
- আহ ঝাওবাবু! ভালো রাজা হতে পারার যে কী আনন্দ! কী অনাবিল ফুর্তি। সে'টা বেঁচে থাকতে যদি জানতাম। 
- বেঁচে থাকতে? আপনি কি মানুষ জন্মেও রাজা ছিলেন মহারাজ? 
- ছিলাম। ছিলাম। বেঁচে থাকতেও আমি রাজাই ছিলাম। কিন্তু ঝাওবাবু! জীবনকালে বড় অত্যাচারী রাজা ছিলাম আমি! বড় অত্যাচারী। গরীবের ঘরে খাওয়ার থাকতো না আমার রাজকোষের অপচয়ের ভারে। মানুষের মানইজ্জত থাকতো না আমার লোভাতুর যত নেশার পাল্লায় পড়ে। রাজ্যে বড় কষ্ট, বড় হাহাকার ছিল ঝাওবাবু!
- ওহ...। কিন্তু প্রতিবাদ করেনি কেউ? আপনার অত্যাচারের বিরুদ্ধে?
- কে করবে? কার ক্ষমতায় কুলোতো? কার কাছে অস্ত্র রয়েছে রাজরোষকে রুখবে?
- অ। বুঝেছি। 
- কিন্তু ভূতের রাজা হয়ে ঠাহর করতে পেরেছি ঝাওবাবু...যে উপকারী রাজার হওয়ার কী আনন্দ। এখন নিশ্চিত বুঝতে পারি যে বেঁচে থাকার সময় রাজ সিংহাসনে বসে কত মন্দ কাজই না করেছি। এখন অপরাধ বোধের চোটে মনে হয়...। 
- কী মনে হয়? রাজন?
- মনে হয় আবার মারা যাই। 
- কিন্তু। মরার রাস্তা তো বন্ধ। আপনিই তো মড়া। মড়ার মরা থাকতে নেই।
- হ্যাঁ। তাই কিছু করতে পারি না। অথচ এদিকে বুকের কাছটা পাথর হয়ে আছে। অসহ্য হাঁসফাঁস। 
- ও। বুঝলাম। অপরাধ বোধ। 
- একদম তাই ঝাওবাবু। প্রবল অপরাধ বোধ। প্রবল যন্ত্রণা। আমি কী করি বলুন দেখি?
- উপায় তো সহজ রাজামশাই। 
- সহজ উপায়?
- অপরাধ কে উড়িয়ে দিন। অপরাধ বোধ আর থাকবে না। 
- এ আবার কী'রকম সলিউশন! যে অপরাধ করে ফেলেছি, তাও আবার মরার আগে, সে অপরাধ উড়িয়ে দেবো কী করে?
- মহারাজ! আপনি এ  ভূতের পাড়ায় নতুন কী না! তাই হয়তো জানেন না। শুনুন। ভূতেরা সময়ের এ দিক থেকে ওদিকে নির্বিবাদে চলে যেতে পারে। 
- সময়ের এদিক থেকে ওদিক?
- আজ্ঞে। মানে। মন চাইলে। আজ থেকে আপনি আগামীকালে চলে যেতে পারেন। চাইলে গতকালও চলে যেতে পারেন। ভূতদের স্পেশ্যাল প্রিভিলেজ। সে আমি শিখিয়ে দেব না হয়।
- কিন্তু তাতে কী? আমার অপরাধ বোধ লাঘব হবে কী করে?
- সহজ। আপনি বেঁচে থাকতে যে সময় রাজা হয়ে অত্যাচার করতেন, সে সময়ে পৌঁছে যান। তারপর সে অপরাধ হাপিশ করে দিলেই হবে। 
- কিন্তু ও'সময়ে আমি ভূত হয়ে ফিরে অরিজিনাল অত্যাচারী আমিকে আটকাবো কী করে?
- না না মহারাজ! আটকানোর কাজ আপনার না। আপনি ওই সময়ে ফিরে গিয়ে নিজের স্যাঙাৎদের তৈরী করুন।  তাদের জাদু ক্ষমতা দিয়ে মজবুত করুন। তারপর তারাই না হয় অত্যাচারী জ্যান্ত আপনার শয়তানিকে রুখবে। আপনারই দেওয়া আশীর্বাদ ধন্য হয়ে। 
- আইব্বাস। এ'টা হতে পারে নাকি? ঝাওবাবু?
- না হলে আর বলছি কী? এবার ভেবে নিন কোন কোন বর অফার করে আপনার স্যাঙাৎদের মজবুত করবেন। ব্যস । 
- ভাবতেই বড় আনন্দ হচ্ছে ঝাওবাবু। হীরক রাজ্যের জ্যান্ত আমির শয়তানি রুখবো এই ভূত আমি। 
- আপনি নয় রাজন, আপনার স্যাঙাৎরা। 
- উফ! আনন্দ আমার হাততালি দিতে ইচ্ছে করছে!।