Skip to main content

নতজানু

চোখের জ্বালাটা ফের ফিরে আসছিল। বুকে পিঠের চামড়ায় অসোয়াস্তিকর চিটচিট। গলার ভিতরটা শুকিয়ে কাঠ। পায়ের গোড়ালি থেকে নিয়ে হাঁটু পর্যন্ত  অসহ্য টনটনে ব্যথা। কিন্তু হাঁটার গতি কিছুতেই কমাতে পারছিল না লোকটা। 

পরনের ধবধবে সাদা জামায় ঘামে আঁকা ক্লান্তিস্তানের সাহসী মানচিত্র। গোটানো হাতার পরিসর ছাপিয়ে ক্লান্ত হাতের মুঠো সপাটে এগিয়ে, সে মুঠো আলগা হয়ে আসে না। পথের ধুলোয় ট্রাউজারের নিচের দিকটা লটপট। তবে এ হাঁটা অসাবধানতার, এ অসাবধানতা যন্ত্রণার। হাঁটার গতি শ্লথ হতে দেওয়া যায় না। 

হাঁটার গতি কমার সাথে সাথে মাথার ভিতরের টিমটিমে ব্যথার টুকরোগুলো ফের জড়ো হয়। ফের। বুকের ভিতর থেকে একটা হাওয়ার দলা পাকাতে পাকাতে পাঁজরা বেয়ে গলা বুকে ছড়িয়ে পড়ে। 

পায়ের পাতায় ব্যথা বাড়ার সাথে সাথে হাঁটার গতি বাড়তে থাকে, সাথে বুকের ধড়ফড়ানি। থামলে চলবে না। গঙ্গার পাশের রাস্তাটা কালচে হলুদ অন্ধকার থেকে অন্ধকারের নীলে মিশে যায়। অবিরাম। লোকটা থামতে পারছিল না কিছুতেই।  কিছুতেই না। যন্ত্রণাটাকে ক্যাপিটালাইজ করে দম ফুরিয়ে আসার সৎসাহসে গা ভাসিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল লোকটা। 

**

- শাদি করোগি মুঝসে?
- বাজে কথা হিন্দিতে বলিস কেন?
- হিন্দি মে বাত হি কুছ অলগ। কনফিডেন্স হি কুছ অলগ।
- বাবু। শাট আপ। চাউমিন খাও। 
- শাদি করোগি মুঝসে?
- চিলি সস্‌ নেই। দিতে বল। 
- ওয়েটারদাদা, চিলি সস্‌ ইধর। প্লিজ। হ্যাঁ,তা যা বলছিলাম। শাদি করোগি মুঝসে?
- বাবু। প্লিজ। 
- প্লিজ। প্লিজ। ম্যায় ভার্চুয়াল নতজানু-নেস অফার করতা হু। নেহাত চাউমিন কা প্লেট হ্যায় সামনে। নহি তো লিটারেলি কর সকতা থা। 
- ইডিয়ট। খা। 
- ওয়াপিস মত যাও। 
- ওয়াপিস যাব না? তোর সাথে থাকবো?
- নহি। ম্যায় রহুঙ্গা তুমহারে সাথ। মাসকাবারির লিস্টকে উপর ঝগড়া করেগা। হম বোলেগা মার্গো, তুম বোলেগা লাক্স। হম বোলেগা বোরোলিন তুম বোলেগা ম্যাগোহ্‌। হাম বোলেগা অনলি চাল, তুমি বোলেগা হাফ চাল হাফ আটা। অন্যদিকে কিচেন মে; হম কুচি করেগা পেঁয়াজ, তুমি ভাজেগা মামলেট। তুম ধোয়েগা কাপড়, হম করেগা ইস্তিরি। তুম করেগা যত কাজ, আমি পায়ে পায়ে ঘুরঘুর।
- এগুলো কেন বলিস?
- সিরিয়াস। মায়ের দিব্যি। নারায়ণ দেবনাথের দিব্যি। 
- থাম!
- ওয়াপিস মত যাও। ম্যারি মি।
- মাঝে অনেকটা তফাৎ বাবু। অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। আর হয় না।
- দিব্যি হয়। ট্যুয়েন্টি নাইনে ফুলহ্যান্ডের মতো। ট্রামে সেকেন্ড ক্লাসের মত। লোকাল ট্রেনে হাওয়ার অপোজিটে বসার জানালার মত। মে মাসের ব্যালকনির আধভেজা গামছার ফুরফুরের মত। 
- লস্যি বল। 
- ওয়েটার ভায়া, একটা লস্যি। একটা পেপসি। ইধর প্লিজ। অউর দেবী, আপ যরা শুনিয়ে! ম্যারি মি প্লিজ। 
- উফ! 
- প্লিজ। প্লিজ। ডু নট গো।
- তুই লস্যি না বলে পেপসি বললি কেন?
- তুই না থেকে কাটছিস কেন?
- আমার ছেলে জন্মদিনে ঢাউস কেক কাটলো। আমি পায়েস রান্না করলাম। তুই এলি না কেন?
- যাসনা। যাসনা বাবু। পকেটে জ্বলজ্বল করছে এক মুঠো গন্ধরাজ। সেই গাছের। 
- ফুল এনেছিস? পাড়ার মাঠের গাছের? বাবু?
- ফুল? এনেছি। তারা সক্কলের পাড়ার মাঠের গাছের নয় অবশ্য।
- ধ্যেত। 
- যাস না। 
- যাব না। খুশি? তুই পারবি সমস্ত সামলে নিতে?
- আলবাত। স্যান্ডো গেঞ্জি আর গামছার জার্সিতে আমি অসাধ্য সাধন করতে পারি। এভারেস্টের মাথায় কলপ করে দিতে পারি। ভিক্টোরিয়ার চাতালে বসে ক্যারম খেলতে পারি। 
- হয়েছে। 

 **

লোকটা যখন টলতে টলতে রাস্তার পাশের কালভার্টটায় থেবড়ে শুয়ে পড়লো তখন রাত ন'টা পেরিয়েছে। আর যাই হোক, বয়ে আনা ক্লান্তিতে আকাশ নিভিয়ে দেওয়া যায় না। চিন্তার বরফকুচিতে সমস্ত ঢেকে যাবেই। প্যান্টের বাঁ পকেট হাতড়ে বেরোলো গোলফ্লেক। আর বুকপকেট থেকে বেরোলো গন্ধরাজ। 

গোল্ডফ্লেক গন্ধরাজ মিলে যে মণ্ড, সে গন্ধের গুঁড়োরা পিঁপড়েদের মত সার বেঁধে ভদ্রলোকের গলায় বুকে ছড়িয়ে পড়লো। বাতাসে তখন সুরেলা শোঁশোঁ ; "মাঝে অনেকটা তফাৎ বাবু। অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। আর হয় না। আর হয় না। আর হয় না"। 

Comments

rags said…
lekhata porar por theke kirokom jeno ekta chinchine byatha shuru hoyeche, jeta r jachcheina kichute

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু