Skip to main content

শখ ও স্নেহ


শখ অতি খতরনাক ব্যাপার।
মেসের চৌকিতে এ'পাশ ও'পাশ করতে করতে সেই খতরনাক ব্যাপারটির খপ্পরেই পড়লেন রাধামাধব। 

রেলের কর্মচারী রাধামাধবের বাড়ি আসানসোলে, কলকাতার এই মেসবাড়িতে পড়ে থাকা শুধু চাকরীর দায়ে। অন্যদিনের মত আজও মেসের ঠাকুরের দায়সারা রান্নায় তিতিবিরক্ত হয়ে গজরগজর করতে করতে শুতে এসেছিলেন তিনি৷ অন্যদিনের মত আজও সে গজরগজরের রেশ কেটে যাওয়ার আগেই তার ঘুমিয়ে পড়ার কথা ছিল। কিন্তু বাধ সাধল শখ। 

রাধামাধবের হঠাৎ গরম রসগোল্লা খাওয়ার শখ হল। ফুটন্ত শখের  দু'চামচ উৎসাহ এসে পড়লে কলকাতা শহরে উপায়ের অভাব হয় না। মেসের অনতিদূরে তেওয়ারি মিষ্টির দোকনখানা রাত দু'টো পর্যন্ত খোলা থাকে,  হালুইকররা সে'খানে কুস্তিগিরদের মেজাজে সর্বক্ষণ কর্মব্যস্ত। শখটাকে প্রথমে দাবড়ে চুপ করানোর চেষ্টা করলেন রাধামাধব,  মগজকে বোঝালেন; রাতবিরেতে এমন হ্যাংলামো অত্যন্ত অদরকারী৷ পাশের তাক থেকে পানমশলার কৌটো নামিয়ে মুখে দিলেন মনকে নরম করতে। কিন্তু তা'তেও কাজের কাজ কিছু না হওয়ায় গা ঝাড়া দিয়ে উঠে, গায়ে ফতুয়া গলিয়ে, মানিব্যাগ হাতে বেরিয়ে পড়লেন।

 শখের প্রাণে বিলম্ব ব্যাপারটা বিছুটির মত ঠেকে। তাই দ্রুত পায়ে তেওয়ারির দোকানে পৌঁছলেন তিনি। ক্যাশবাক্সে মাথা রেখে ঘুমিয়ে একটা বছর বারোর ছোকরা। ডাকতে মায়া হল। কিন্তু গরম রসগোল্লার সুবাসটুকু চিনতে ভুল করলেন না রাধামাধব।  খানিকক্ষণ আগেই বৃষ্টি হয়েছে, বাতাসে এখনও মিঠেভাব। সেই মিঠে বাতাসের সঙ্গে গরম রসগোল্লার সুবাস মিলে একটা মখমলে ভালোলাগা তৈরি হচ্ছিল। 

"এই যে" সম্বোধনে ক্যাশবাক্স আগলে রাখা ছোকরাটির ঘুম ভাঙানো গেল। 

"চারটে রসগোল্লা নিয়ে এসো৷ গরম দেখে আনবে"।

তিরিশ সেকেন্ডের মাথায় ছোকরাটি একটা প্লেটে চারটে রসগোল্লা সাজিয়ে নিয়ে এলো। 

প্লেটে সাজানো রসগোল্লাগুলোর দিকে তাকিয়ে খোকার কথা মনে পড়ল রাধামাধবের। বাড়ি ফেরার সময় খেলনা আর মিষ্টি নিয়ে যাওয়াটা রাধামাধবের অভ্যাস। চার বছরের খোকা খেলনার আগে ঝাঁপিয়ে পড়বে মিষ্টির বাক্সের ওপর। আর রসগোল্লা তো তাঁর অতি প্রিয়। 

খোকার কথা ভাবলে বুকের মধ্যে কেমন তিরতিরে কান্না ভেসে বেড়ায়৷ মাস গেলে মাত্র একবার দেখা,তাও মাত্র দু'দিনের জন্য। এমন নরম রসগোল্লা, খোকা কী ভালোই না খেত৷ খোকার মা নিশ্চয়ই মাঝেমধ্যেই তাকে রসগোল্লা কিনে খাওয়ায়। কিন্তু তবু, ইচ্ছে মত নিজের হাতে খোকাকে রসগোল্লা খাওয়াতে না পারার মনখারাপ যে কী প্রবল৷ বর্ষার মিঠে হাওয়া, গরম রসগোল্লার সুবাস আর ঝাপসা চোখ অত্যন্ত গোলমেলে কম্বিনেশন। 

- তোমার নাম কী খোকা?

- ভুটকাই। এই নিন রসগোল্লা। আর চারটে মিলে চল্লিশটাকা। 

- এই যে, টাকাটা।

- প্লেটটা নিন।

-  ভুটকাই, রসগোল্লা খাবি?

- কী?

- খাবি? রসগোল্লা? জানি,যে দোকানে গোটাদিন কাজ করিস, এ তো সে'খানকারই রসগোল্লা৷ কিন্তু খাওয়ানোর রকমফেরে স্বাদ এসপারওসপার হয়ে যায়। খাবি? আয়। আয়।

স্নেহ। স্নেহ অতি খতরনাক ব্যাপার। 
হতভম্ব ভুটকাইয়ের মুখে রসগোল্লা পুরে দিতে দিতে সে'টাই ভাবছিলেন রাধামাধব।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু