Monday, July 20, 2020

বটুগোয়েন্দার ইলিশচুরি

- এই যে বউ...।

- অত চেল্লাচিল্লি কেন।

- চেল্লাচিল্লি করার মতই দাঁও মেরেছি।

- চোরের গলায় অত তেজ ভালো না..।

- বিশু দারোগা চোর বলে চোপা করলে গায়ে লাগেনা। কিন্তু তুমিও চোরছ্যাঁচড় বলেই হ্যাটা করবে গো বউ? শিল্পীর কদর করবে না?

- উঁ। ভীড় বাসট্রেন থেকে এর ব্যাগ ওর থলে সরানোও নাকি শিল্প। ধুর ধুর শিল্পী ছিলেন মধুজ্যেঠু। গেরস্ত বালিশে মাথা ঠেকানোর দশ মিনিটের মধ্য সিঁদ কেটে মালপত্তর সরিয়ে হাওয়া।

- আরে সে মান্ধাতা আমলে পড়ে থাকলে চলবে কেন। ইন্টারনেটে চারদিকে কিস্তিমাত হচ্ছে। এ যুগে সিঁদ কাটলে লোক হাসবে যে। তবে যাক। আজ এক্কেবারে কেল্লাফতে করেছি। এই দ্যাখো।

- রামোহ্। চামড়ার দামী ব্যাগ নয়, জমকালো বটুয়া নয়, এ যে দেখি বাজারের থলে...। তাও ময়লা...।

- কিন্তু বউ, এ থলের মধ্যেই যে সাতরাজার ধন। 

- আহ, কী আছে সে'টা বলবে তো।

- ডাউন মেমারি লোকালে ফিরছিলাম। তখনই নজরে পড়ল লোকটাকে। গোবেচারা চেহারা, ট্রেনের দরজার এক্কেরে মুখে দাঁড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছেন বাবু। ...দেখেই বুঝেছি এর মাথায় কাঁঠাল ভাঙা বাংলায় বানানভুল করার চেয়েও সহজ। ব্যাস। অমনি পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। তা ভদ্দরলোকের হাতে ঝোলানো থলির ভিতর উঁকি মারতেই বুকের মধ্যে এক্কেবারে যেন সাতশো বত্রিশটা রংমশাল জ্বলে উঠল। ঠিক করে ফেললাম এ ব্যাগ না হাতালেই নয়..। ভদ্রলোক শক্ত করে থলেটা ধরেছিলেন..। প্রথমে ভাবলাম।যে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে ট্রেন গতি নিলে; সে ব্যাগ শেষ মুহূর্তে ছিনিয়ে ট্রেন থেকে দৌড়ে নেমে পগারপার হওয়াটাই একমাত্র উপায়। কিন্তু মা ভবতারিণীর আজ অসীম দয়া; ছিনতাইয়ের হ্যাপা পর্যন্ত যেতেই হল না। হঠাৎ এক প্যাকেট সল্টেড বাদাম কিনে খেতে শুরু করলেন ভদ্রলোক,হাতের থলেটা পাশে নামিয়ে রেখে। সে বাদামের নেশায় এতটাই বুঁদ হয়ে ছিলেন যে আমি দিব্যি থলে উঠিয়ে পাণ্ডুয়া স্টেশনে স্যাট করে নেমে পড়লাম অথচ সে'টা সেই থলেওলা টেরই পেলেনা। 

- হাউই গপ্প তো অনেক হলো। তা এই থলেতে আছেটা কী?

- দেখাব। তার আগে খোকা আর খুকিকে ডাকো দেখি। ওদের সামনেই না হয়...।

***

- পৌনে দু'কিলো সাইজের ইলিশ?

- করেক্ট।

- দু'টো ইলিশ?

- করেক্ট।

- কোয়ালিটি?

- এ-ক্লাস।

- তুমি জানো সে জিনিসের মার্কেট ভ্যালু কত?

- হিসেব করতে গেলে ভির্মি খেতে হবে। থাক না।

- থাক না মানে? অমন ইলিশ সহ থলে গায়েব হয়ে গেল?

- গায়েব নয়। চুরি।

- বটু গোয়েন্দার ইলিশ মাছের থলি চুরি হল?

- এতে এত অবাক হওয়ার কী আছে সুবিনয়।

- অবাক হব না বটু? থানার বড়বাবুরা তোমার কনসাল্টেশনের জন্য হন্যে হয়ে ঘোরে। দুঁদে ক্রিমিনালরা তোমার নাম শুনলে থরথর করে কাঁপে। তেমন গোয়েন্দার মাছের থলে চুরি হয়ে গেল ট্রেনের ভিড়ে, অথচ সে টেরটিও পেল না। বাজারে এ কথা রটলে তোমার মানইজ্জত থাকবে বটু?

- মানইজ্জতের পরোয়া করলে কি আর ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়াতাম হে সুবিনয়। সে চিন্তা নেই।  ইলিশের থলে চুরি হয়েছে বটে, কিন্তু তা আমায় ফাঁকি দিয়ে হয়নি।

- তার মানে? তুমি টের পেয়েছ যে তোমার থলি চুরি হচ্ছে?

- হাপিসটি হয়েছে পাণ্ডুয়া স্টেশনে। আর চুরিটা হয়েছে আমার সুপারভিশনে।

- তার মানে?

- চুরিটা আমি অ্যালাউ করেছি।

- তুমি চুরিটা হতে দিয়েছ?

- করেক্ট।

- তুমি দেখেছ সে চোরকে?

- বয়স পঁয়তাল্লিশ থেকে সাতচল্লিশের মধ্যে। একমাথা এলোমেলো ময়লা চুল, নীল শার্টটিকে আর যাই হোক নতুন বলা চলে না। ট্রাউজারটা এককালে হয়ত মিশকালো ছিল, এখন ফ্যাকাসে। পায়ে সস্তা হাওয়াই চটি। হাতে একটা পুরনো ইলেকট্রনিকস ঘড়ি, নেহাৎ শস্তা নয় তবে সে'টি যে চুরির মাল সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। 

- তা এই লোকটিকে তুমি তোমার থলে সরাতে দিলে?

- দিলাম। ইনফ্যাক্ট, যতটা সম্ভব সাহায্য করলাম। 

- খোলসা করো হে বটু।

- চোরের হাবভাব আমি বিলক্ষণ চিনি। তাঁদের আঙুল আর কবজির মুভমেন্ট, চোখের ধারলো ফোকাস আর ঠোঁটের পরিশীলিত উত্তেজনা; এই কম্বিনেশনটা নিশ্চিত ভাবে ঠাহর করতে পারাটা যে কোনও গোয়েন্দার জন্যেই একটা জরুরী স্কিল। তবে এই ভদ্রলোক..।

- ভদ্রলোক?

- সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায় নিজের আখের গোছানো মানুষজন যদি ভদ্র হতে পারেন, সামান্য পকেটমারকে ছোটোলোক বলি কী করে বলো। যাকগে, তা অন্যদের পকেট আর ব্যাগ জরীপ করতে করতে এই নীল শার্ট ভদ্রলোকটি হঠাৎ একটা বই হকারের কাছে ছোটদের বই চেয়ে দরদাম শুরু করলেন। ওই সস্তা চটিবই। ট্রেন কাঁপানো দরদাম করে দু'টো বই বাগালেন ভদ্রলোক; একটা গোপাল ভাঁড়ের হাস্যরস আর একটা বীরবলের গল্প। কেনার পর বইগুলো নিজে একবারও উল্টেপাল্টে না দেখে নিজের বুকপকেটে যত্ন করে মুড়ে রাখলেন। বই কেনার সময়টুকু ভদ্রলোকের চোখ থেকে সেই ফোকাস গায়েব, ঠোঁটের উত্তেজনা কেটে গিয়ে উজ্জ্বল হাসি আর আঙুলের চনমন গায়েব। কেন?

- কেন?

- শিল্পীর ফোকাস আর উত্তেজনা ভাসিয়ে দেওয়া স্নেহ। বাড়ির বাচ্চাদের জন্য কি ভদ্রলোক দু'টো বই হকারের ব্যাগ থেকে সরিয়ে দিতে পারতেন না? পারতেন৷ কিন্তু তা করলেন না কেন? কারণ ছোটদের পড়ার বইটুকু তিনি চুরি করে সংগ্রহ করতে চাননি। শিক্ষার প্রতি সম্মান। আমাদের অনেকের মধ্যে নেই, ওঁর আছে। আসলে মানুষের এথিকস বোধ অতি বিচিত্র হে সুবিনয়। যা হোক, বইদুটো কেনার পর ভদ্রলোকের চোখের ফোকাস আর ঠোঁটের উত্তেজনা ফেরত এলো। অর্থাৎ তিনি ফের শিকারী বাজপাখি। এসে দাঁড়ালেন আমার পাশে। তাঁর দৃষ্টি এসে পড়লো আমার থলের ওপর৷ প্রমাণ সাইজের দু'টো ইলিশ দেখে তার চোখের দৃষ্টি আরও প্রখর হয়ে ওঠা উচিৎ ছিল, ঠোঁট লোভে কেঁপে ওঠা উচিৎ ছিল। অথচ...।

- অথচ?

- অথচ তার দৃষ্টি হয়ে উঠল ঘোলাটে। ঠোঁটে ফুটে উঠল বিষাদ। আর নিজের অজান্তেই তিনি বুক পকেটে মুড়ে রাখা বইদুটো খামচে ধরলেন। এথিকসের মতই, পিতৃস্নেহও রীতিমতো বেহিসেবী একটা প্রসেস৷ আমার ইলিশের থলিটি তাকে টানলো কিন্তু সে টানে লোভ নেই৷ সে টানে নিজের সন্তানদের মুখে ইচ্ছেমত মাছের টুকরোটা তুলে দিতে না পারার আক্ষেপ রয়েছে৷ যন্ত্রণা রয়েছে। ব্যাস, তারপর আর কী। মক্কেলের ঘাড় মটকে আদায় করা ইলিশ আবারও জুটেই যাবে।

- ইলিশভাজা দিয়ে জমিয়ে আড়াই থালা ভাত খাবো ভেবে এসেছিলাম হে বটু। কাজটা তুমি খারাপ করোনি বটে৷ তবু আমার বুকের ভিতরটা কেমন যেন খালি খালি বোধ হচ্ছে..।

- গোয়েন্দাগিরির নেশায় মশগুল না হলে আমি অতি চমৎকার রাঁধুনি হতাম সুবিনয়। যাকগে, হাঁসের ডিম কষা করেছি, তাতেও ওই আড়াই থালা ভাত সাবাড় হবেই। দেখে নিও।

1 comment:

Unknown said...

কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা ....অসাধারণ ।।