Skip to main content

বিমলবাবুর দরজা


- ও বিমলবাবু। ও বিমলবাবু। ও বিমলবাবু।

- কী চাই?

- দরজাটা খুলুন। তারপর তো কথা হবে।

- এত রাত্রে এমন হাঁকডাক শুরু করেছেন কেন?

- আরে মশাই আগে দরজাটা তো খুলুন।

- এই রাতবিরেতে? দুম করে দরজা খুললেই হল?

- আহা, আমি তো আর অচেনা কেউ নই। 

- যে'টুকু চিনি..ততটুকু যথেষ্ট নয়।

- চেনার কি কোনও শেষ আছে বিমলবাবু? নেই।

- দেখুন। এত রাত্রে আমি দরজা খুলব না। কভি নহি।

- এ এক অদ্ভুত জেদ। অভিমন্যুর মত। রথের ভাঙা চাকা বাগিয়ে সাতজন মহারথীকে ঠেকানো যায় বলুন? দরজা আপনাকে খুলতেই হবে।

- থ্রেট করছেন?

- অন দ্য কন্ট্রারি। আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।

- যত বাজে কথা। দরজা আমি খুলব না।

- দরজা কি কাগজ? আমি কি এনআরসি? আচ্ছা বেশ। আমি না হয় দরজার এ'পাশেই বসে জিরিয়ে নিই খানিকক্ষণ। 

-  আচ্ছা ঘ্যাঁতা ইয়ে তো আপনি।

- আপনার ইচ্ছে করছে দরজা খুলতে।

- মোটেও না৷ খবরদার ম্যানিপুলেট করবেব না৷ ও দরজা আমি খুলব না। না, না, না। 

- আজ যে গোটা রাত আমাদের গল্পগুজব করার কথা বিমলবাবু।

- রাত্রে না ঘুমিয়ে আপনার সঙ্গে গল্প করব? আমি কি পাগল না প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চি?

- আপনি ভালোবাসিয়ে বিমলবাবু৷ ভালোবাসিয়ে। এ দরজা না খুলে আপনার উপায় নেই। 

- মাঝরাত্তিরে এ সব কী ধরণের বিটকেল ন্যাকাপনা মাইরি।

- যে ভালোবাসার মুহূর্তে আপনি আজ ফিরতে চাইছেন, তার জন্য যে আমি ছাড়া গতি নেই।

- আপনার মত থার্ডক্লাস কারুর হেল্প আমার চাইনা।

- ক্লাস বলে আমার কিছু আছে ভেবেছেন? কেউ ভাবে আমি ফোরটুয়েন্টি, কেউ বুক বাজিয়ে বলে আমি বাউল। কেউ হয়ত দিনের বেলায় আমায় 'শ্যালো, পাতি, ট্যু মেনস্ট্রিম' বলে নাক কুঁচকে পাশ কাটিয়ে যায়।  আবার সেই হয়ত রাত্রিবেলায় আমাকে সাদা ওয়াড়ে ঢাকা নরম পাশবালিশের মত বুকে টেনে নেয়। ক্লাস, জাত; সে'সব আমার থাকতে নেই।

- ও'সব হাবিজাবি কথায় আমার ব্রেন গুলিয়ে দেবেন ভেবেছেন? লাভ নেই। দরজা খুলব না। 

- আমি ছাড়া যে আপনার এ ব্যথার অ্যান্টিসেপ্টিক নেই বিমলবাবু।

- ব্যথা? ব্যথা আবার কীসের? দিব্যি ফুর্তিতে আছি। রাত্রে ইলিশের পেটি ভাজা দিয়ে আড়াই থালা ভাত খেয়েছি৷ 

- তবুও মনভার। চোদ্দ বছর আগের সেই মনখারাপ করা বিকেলে একবারটির জন্য ফিরতে না পারলেই নয়।

- খবরদার! বাড়াবাড়ি হচ্ছে।

- স্কুলের গন্ধ। জোড়া বিনুনি আর নীল স্কার্টের হুহু।  বাপুজি কেকের স্বাদ। খবরের কাগজের আজহারউদ্দিনের চারপাশ দিয়ে কাঁচি চালানোর মখমলে অনুভূতি। সে'দিনটায় ফিরে যেতে হলে আমি ছাড়া যে গতি নেই।

- সেই বিকেল? চোদ্দ বছর আগের বিকেল? সেই বিকেলেও আপনি ছিলেন। আপনাকে তখনও পাত্তা দিইনি। আজও দেব না।

- সে বিকেলের স্টক প্রাইস এমন হুহু করে বেড়ে যেতে পারে, সে'টা কি তখন আঁচ করতে পেরেছিলেন? বিমলবাবু?

- না মানে...।

- স্কুল শেষ। জোড়া বিনুনি হাওয়া। বাপুজি নাথুরামে। আজহার দুম করে অন্ধকারে। শুধু আমিই রয়েছি। দরজাটা খুলুন। 

- কিন্তু...আপনার জন্য দরজা খুলতে হবে...সে'টা আমি ঠিক..।

- ভাবতে পারেননি। জানি। আর এ'টাও জানি যে একা আমিই পারি ওয়ার্ম হোল হয়ে আপনাকে সে বিকেলে ফেরত নিয়ে যেতে। 

- সেই বিকেলে..সেই বিকেলে...।

- সে বিকেলে ফিরে যেতে না পারলে আপনার মুক্তি নেই৷ দরজাটা খুলুন।

***

মাঝরাত্তিরে পুরনো অবহেলিত গানেরা মানুষ শিকারে বেরোয়৷ 
এই যেমন আজ। এফএম চ্যানেলটা পাল্টাতে গিয়েও থমকালেন বিমলবাবু।

এর আগে বহুবার শুনেও পাত্তা না দেওয়া সাতপুরোনো  সস্তা গদগদে বলিউডি গানটাকে; 
মনের দরজা খুলে নিজের কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরলেন তিনি।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু