Skip to main content

নিতাইদার আত্মজীবনী



- নিতাইদা গো..। 

- সিগারেট চেয়ে লাভ নেই ভাইটি। বাক্স খালি। এই দ্যাখ।

- আহ, ধান্দা ছাড়া কি তোমায় মাইডিয়ার টোনে ডাকতে নেই গো? কত রেস্পেক্ট করি তোমায়।

- মদে রেস্পেক্ট-ভালোবাসার পরিমাণ সামান্য বাড়ে বটে।

- পেটে দু'পেগ রাম পড়েছে বলে বলছিনা নিতাইদা। এই যে ছ'সাত মাস অন্তর কলকাতা আর সংসার ছেড়ে তোমার এই মগরার ব্যাচেলর প্যাডে দু'রাত কাটিয়ে যাই, তার মূলে কিন্তু ওই; ডীপ অ্যান্ড সিনসিয়ার রেস্পেক্ট। আর অন টপ অফ দ্যাট..আ বুক ফুল অফ ভালোবাসা। 

- বুঝলি পলাশ, তোর মত ছেলেবেলার চ্যালাচামুণ্ডাদের আনাগোনা আছে বলেই...আমার এই একার গেরস্থালীও গুলজার রয়েছে।

- নিতাইদা, তুমি এই স্কুলমাস্টারি নিয়ে পাড়া ছাড়ার পর থেকে গোটা পাড়াটাই কেমন ম্যাদা মেরে গেল। দলের ছেলেপিলেরাও সবাই চাকরীবাকরি নিয়ে এমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল..।

- পাড়ার কথা আমারও খুব মনে পড়ে রে।

- তা'হলে আর আসো না কেন?

- বাপ-মা নেই। তোরা এখনও ভুলিসনি, এখানে মাঝেমধ্যেই ঘুরে যাস। আর ফিরব কী জন্য বল।

- তোমার মনে পড়ে নিতাইদা? তোমার ক্যাপ্টেনসি আর অফস্পিনে ভর দিয়ে আমরা টানা তিন বছর টুর্নামেন্ট জিতেছিলাম? 

- ওই সেই ভবতারণ সমাদ্দার স্মৃতি ট্রফি তো? ফাইনালিস্টদের পিকনিক করার জন্য টাকাও দেওয়া হত মাইরি। 

- হরেনদার দোকানে গেলেই এখনও ও তোমার কথা জিজ্ঞেস করে।

- ওর বানানো চা আর পোচের স্বাদ ভোলবার নয়।

- আর টুপাইদির সঙ্গে কম্পিটিশনে খাওয়া ফুচকা? তার স্বাদ? 

- টুপাই। টুপাই। 

- ব্যথা পেলে?

- ব্যথা যে'টুকু পেলাম তা ফুচকার কথা মনে করালি বলে রে। পাড়ার বিনোদদার ফুচকা খেয়েছি বলেই বলছি, বিনোদদার ট্রেনে কাটা পড়াটা ফুচকা-শিল্পের জন্য যে কী ভীষণ  ড্যামেজিং...ভাবলেই শিউরে উঠি। 

- তোমার পেটেও তো দু'পেগ পড়েছে দাদা৷ টুপাইদি সম্পর্কের ব্যথাটুকু একটু ঝেড়ে কাশো না।

- তোদের সবার কানটান মুলে ক্যালকুলাসে মোটের ওপর দাঁড় করিয়ে দিতে পেরেছিলাম৷ শুধু টুপাইটার ফাউন্ডেশন এতটাই উইক ছিল...তেমন কিছু করা গেল না। আচ্ছা, ওর একটা মেয়ে হয়েছে না? আশা করি ওর মেয়ে অন্তত ওর ক্যালকুলাস-ইগনোরেন্সটা ইনহেরিট করবে না। 

- একটা কথা বলি গো নিতাইদা?

- পেটে কথা চেপে রাখলে ওল্ড মঙ্কের ইনসাল্ট রে পলাশ। চটপট বলে ফেল।

- তুমি এককালে তো লেখালিখি কম করতে নাম। কত পত্রপত্রিকায় সে'সব নিয়মিত ছাপাও হত। তা, নিজের বায়োগ্রাফি একটা লেখো না৷ তোমার লাইফে যে কী লেভেলের মশলা লুকিয়ে আছে তা তো আর আমার অজানা নয়। এক্কেবারে জম্পেশ হবে কিন্তু। 

- আমার জীবনী? 

- ইয়েস। তোমার জীবনী তো রীতিমত নভেল। লেখোই না। আমার ব্রাদার ইন ল'টি আজকাল পাবলিশার হিসেবে বইপাড়ায় কিঞ্চিৎ সুনাম অর্জন করেছে...তুমি যদি লেখ তা'হলে আমি বলে কয়ে...।

- সে কাজ অলরেডি করে রেখেছি।

- তোমার জীবনী? আইশ্লা...রেডি?

- টোটালি। তবে লিখেটিখে নয়। ফর্ম্যাটটা অন্য। 

- মাথায় রাম রাম ঝিমঝিম, হেঁয়ালি সইবে না নিতাইদা। কই তোমার বায়োগ্রাফি? দেখাও দেখি।

- একটা জবরদস্ত কোলাজ ফর্মে রয়েছে।

- কোলাজ?

- কোলাজ। ওই দ্যাখ।

- ও'টা...? ওই বেঢপ বুকশেল্ফগুলো? 

- ইয়েস। আমার বায়োগ্রাফিকাল কোলাজ।

- মাইরি নিতাইদা, আমি বেশি মাতলামি করছি না তুমি করছ, কে জানে।

- না রে পলাশ।  মাতলামি নয়। প্রতিদিনই এই বুকশেল্ফের দিকে আমি একটানা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকি। ওই যে, নীচের দিকে দেখ; রাদুগা প্রকাশনীর রাশিয়ান রূপকথার বই। আমার দাদু ছেলেবেলায় কিনে দিয়েছিলেন; তখনও আমি পড়তে শিখিনি, শুধু পাতা ওল্টাতাম আর ছবি দেখতাম হাঁ করে। উপেন্দ্রকিশোরের ছেলেদের মহাভারত দিদার দেওয়া, কী'ভাবে যে বইয়ের ভিতরে সতেরো নম্বর পাতায় দিদার রান্না করা হাতের হলুদের ছোপ লেগেছে জানিনা। খুব আবছা একটা দৃশ্য মনে পড়ে; দিদা রান্না করছে আর আমি একটা ছোট্ট কাঠের টুলের ওপর বসে ওই বই নাড়াচাড়া করতে করতে দিদাকে হাজার রকমের প্রশ্ন করছি৷ আর ওই বইটা দ্যাখ, ওই যে নীল বাঁধাইয়ের। ওটা অস্কার ওয়াইল্ডের সেল্ফিশ জায়ান্ট আর অন্যান্য নির্বাচিত গল্প। ক্লাস সেভেনের অঙ্ক পরীক্ষায় হাইয়েস্ট নম্বর পাওয়ার জন্য প্রাইজ। ওই বই ছুঁয়ে আমি টের পেয়েছিলাম আমি অঙ্ক ভালোবাসি। প্রসেসটা বোঝানোর ভাষা আমার নেই, তবে ভালোবাসা যেমনটা হওয়া উচিৎ আর কী; ভালোবাসি, ব্যাস৷ সেই প্রাইজ পাওয়ার দুপুরটা আমার আজও মনে আছে; অঙ্কের মাস্টার মধুময় স্যার স্টেজে সেদিন সে বই হাতে তুলে দিয়েছিলেন আবার স্টেজে দাঁড়িয়েই কানও মলেছিলেন পরীক্ষায় একটা কেয়ারলেস ভুলের কথা মনে করিয়ে। এ'বার এই শরদিন্দুর ঐতিহাসিক কাহিনীর বইটা দ্যাখ, ওই যে, ওপরের তাকের ডান কোণে। বাবা আমার মধ্যে ইতিহাসের প্রতি সমীহ ইঞ্জেক্ট করেছিল ওই বই থেকে পড়ে শুনিয়ে। শরদিন্দুর গল্পের ঘাড়ে বাবা চাপিয়ে দিতেন নিজের কিছু ফ্যাকচুয়াল ফুটনোট। বাবার কণ্ঠস্বর কানের মধ্যে গমগম করে ওঠে জানিস; ওই বইটার দিকে তাকালেই। মা আর আমি প্রায় একসঙ্গে পড়েছিলাম লোটাকম্বল; তখন আমি ক্লাস নাইনে বোধ হয়। এই বই পড়ার ব্যাপারে আমাদের বাড়িতে অদ্ভুত সাম্যবাদ ছিল। আমি কোনওদিন শুনিনি, ছোট বলে অমুক বই পড়তে পারব না। ওই দেখ, মাঝের তাকে ওই ছেঁড়া মলাটের লোটাকম্বলটা রাখা আছে। মা যেদিন মারা গেল, শ্মশান থেকে ফিরে গোটা রাত আমি শুধু সঞ্জীব পড়েছিলাম জানিস। সে সব কটা বইই মজুদ আছে, সে রাত্রের কান্না আর গন্ধ সমস্ত ওই বইগুলোয় জড়িয়ে। আর ওই যে শিব্রাম সমগ্রটা...দেখেছিস? হ্যাঁ ও'টা। ওইটে ছিল আমার প্রথম প্রেমের এনভেলপ।

- কী? কীসের এনভেলপ?

- টুপাই ওই বইটা ধার নিয়েছিল পড়বে বলে। ফেরত পাওয়ার পর দেখি পাতার ফাঁকে একটা দু'পাতার চিঠি। টুপাইয়ের ক্যালকুলাস নড়বড়ে হতে পারে, কিন্তু ওর হাতের লেখা সত্যিই মুক্তোর মত। আর আমার সব মিলে একশো তেরোটা চিঠি লিখেছিল; কোনওদিনও একটাও বানান ভুল করেনি। যাকগে। ওই যে পুরনো পুজোসংখ্যাগুলো দেখছিস; আমি প্রতিটি বইয়ের প্রতিটি উপন্যাস কোন দিন কাদের পাশে বসে শেষ করেছি, সবটুকু গড়গড় করে বলে যেতে পারব। আর এই যে, দ্বিতীয় তাকে জ্বলজ্বল করছে দ্যাখ।  আমার পাড়া ছাড়ার ফেয়ারওয়েলে তোরা...অর্থাৎ মাই ডিয়ারেস্ট চ্যালাচামুণ্ডাসরা এই আধবুড়োকে হাঁদা-ভোঁদা, বাঁটুল আর নন্টে-ফন্টে সমগ্র উপহার দিয়েছিলিস। ওল্ডমঙ্কের বোতল আমার একা খুলতে ইচ্ছে করে না, তাই একা থাকলে নারায়ণ দেবনাথই আমার জন্যআইডিয়াল ফর্ম অফ স্কচ। কারণ ওই কমিক্সের বইগুলোর প্রতিটি পাতায় রয়েছে ভবতারণ সমাদ্দার স্মৃতি ট্রফি জেতানো উত্তেজনা। 

- হেহ্। বুঝলাম।

- দ্যাখ পলাশ। মোদ্দা কথা হল, আমার এই বাড়ির খানতিনেক বইয়ের শেল্ফ জুড়ে যে শ'চারেক বই রয়েছে; সেগুলোর আত্মাকে আমি লেখক ও প্রকাশকের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে নিজের পোষ্য করে রেখেছি। ওগুলো এখন শুধুই আমার হয়ে,আমার জন্য আমার গল্প বলে। সে গল্পগুলো মিলিয়ে মিশিয়ে একটা চমৎকার বায়োগ্রাফি তৈরি হয়। অ্যাকশন, থ্রিল, রোম্যান্স, ট্র‍্যাজেডি, ইমোশনাল ওভারডোজ; কী নেই সে'খানে। যাকে বলে;  রীতিমতো সিনেম্যাটিক। রোজ আমি এই বইগুলোর সামনে এসে দাঁড়াই আর নিজের জীবনের এক একটা চ্যাপ্টার সিনেমার মত চোখের সামনে ভেসে ওঠে।  আলাদা করে লেখালিখি করে, প্রকাশক ধরে, পাঠক পাকড়াও করে এ ম্যাজিক নষ্ট করার মানে হয়? তুইই বল?

Comments

গল্পের কাহিনীটা বেশ ভালো লাগলো।
Another emotional overdrive..

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু