Skip to main content

গুরুপদর সাপ্লাই


- নিশিকান্ত নাকি?

- আজ্ঞে।

- তুমি আবার দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কেন। ভিতরে এসো, এসো।

- আজ্ঞে।

- ওই মোড়াটা টেনে বসো দেখি। 

- আজ্ঞে...বসব?

- ও। তোমার তো আবার দাঁড়ানোও যা, বসাও তাই৷ 

- আজ্ঞে।

- তা শরীরটরীর ভালো তো?

- আজ্ঞে? শরীর?

- আহা তাই তো। তোমার আবার শরীর। বয়স হয়েছে তো৷ মাথাটাথা গুলিয়ে যায় মাঝেমধ্যেই।

- আজ্ঞে...বিরানব্বুই আর এমন কী..।

- বাতের ব্যথাটা এমন বাড়াবাড়ি শুরু করেছে আজকাল...বুঝলে বাবা নিশিকান্ত...।

- আজ্ঞে..দেব নাকি পা টিপে?

- গলা টেপার বদলে মানুষের পা টিপবে ভাই নিশি? ধর্মে সইবে?

- কী যে বলেন..আজ্ঞে। যবে থেকে আপনার শ্রীচরণে ঠাঁই পেয়েছি...ও'সব শয়তানি ছেড়ে দিয়েছি।

- তা দিয়েছ বটে। শোন বাবা নিশিকান্ত, এসেছই যখন...কুকারে একটু চাল আর আলু চাপিয়ে দিয়ে যেও। ভয় নেই, আগুন জ্বালতে আমি এখনই বলব না। তুমি তৈরি হওনি এখনও। তুমি শুধু চাপিয়ে দিয়ে যেও। আমি উনুন জ্বেলে নেব'খন।

- আজ্ঞে। আসলে...আগুনের ভয়টা এখনও ঠিক কাটিয়ে উঠতে পারিনি৷ 

- অঙ্কে প্র‍্যাক্টিস আর তন্ত্রে সাধনা...এই দুইয়ে ফাঁকি দিলে চলবে না। 

- আজ্ঞে...ফাঁকি ঠিক দিইনি। সাধনায় কাঠখড়ও কিছু কম পোড়াচ্ছিনে। কত দিন চেষ্টা করার পর গিয়ে গলা টেপার লোভ ছাড়তে পেরেছি। দুমদাম মানুষের পিলে চমকে ফুর্তি করার অভ্যেসও..ইয়ে...আগের মত নেই। সামান্য মাছের আঁশের পচা গন্ধ শুঁকে একটু ফুর্তি করতাম...তাও ছেড়েছি বছর দুই হল। শুধু শ্মশানের বাইরে আগুন দেখলে এখনও বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে....। ফাঁকিবাজ হলে, এ'সব কি হত আজ্ঞে?

- বলি যে মন্ত্রটা দিয়েছিলাম, সে'টা রাতে আড়াইশোবার আওড়াচ্ছ কি?

- ওই যে..খ্যাটিম্যাটি খ্যাংখ্যাং জবাট্যাং মাংটক...আকিসুকি কুলঘুল জিল্যাটাং ভড়কক? আজ্ঞে?

- ওইটাই...তা, মন্ত্রটা আওড়ানো হচ্ছে কি? প্রতি রাতে? আড়াইশোবার?

- তা হচ্ছে। কোনও কোনওদিন হয়ত বার চল্লিশেক বার কমবেশী হয়ে যায়।

- সাধনায় কম বেশি চলে না হে। চলে না। দেখ নিশিকান্ত, এক ভূতকে নিয়ে এত বেশি সময় নষ্ট করলে আমার চলবে কেন? আরও কতজন লাইনে রয়েছে জানো?

- আজ্ঞে, আপনার দয়াদৃষ্টি থেকে এ অধমকে বঞ্চিত করবেন না যেন৷ আমি আজ থেকেই হাজারবার করে সে মন্তর পড়ব। আর ছ'মাসের মধ্যে নিজের হাতে আপনার স্টোভ জ্বলে আপনাকে বেগুনি ভেজে, খিচুড়ি রেঁধে খাওয়াব। 

- সাধনায় ফাঁকি চলে না, বাড়াবাড়িও না। পাক্কা আড়াইশো বার, রোজ রাতে। 

- যে আজ্ঞে। আমি প্রমাণ করে ছাড়ব যে আমি ভূতমাস্টার গুরুপদ হালদারের যোগ্য ছাত্র। 

- গদগদে আর বাঁচিনা। যাও, গিয়ে হাঁড়িটা বসাও।

**

- দেখুন গুরুপদবাবু, আমার ফ্যাক্টরিতে ডিমান্ড যে'ভাবে বাড়ছে...আপনার থেকে সাপ্লাই তেমন ভাবে পাচ্ছি কই বলুন। অন্য ভূত ট্রেনারের কাছে না গেলে আমার বোধ হয় আর চলবে না। আফটার অল, আই হ্যাভ আ বিজনেস অ্যান্ড আ ফ্যাক্টরি টু রান। 

- অমনটি বলবেন না মিস্টার চ্যাটার্জী। অমনটি বলবেন না। আপনার সোদপুরের ফ্যাক্টরির সমস্ত লেবার ভূত আমিই সাপ্লাই দেব, ও নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। আজকাল দু'চারটে ভূত এমন ত্যাঁদড় বেরোয়...তাদের ট্রেন করতে দিনের পর দিন...।

- ও'সব অজুহাত শুনলে আমার চলবে কী করে গুরুপদবাবু? একটা ভূত সাপ্লাইয়ে দেরী করা মানে তার বদলে আমায় একশোটা রোবট ডেপ্লয় করতে হয়৷ এদিকে একটা ভূতের মেন্টেনেন্সের তুলনায় একটা রোবট মেন্টেন করার খরচ দশগুণ বেশি। অর্থাৎ আমার লেবার কস্ট দাঁড়ায় থাউজ্যান্ড টাইমস মোর। আপনার এক একদিনের দেরী আমার প্রডাকশন কস্ট কী ভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে সে খেয়াল আছে?

- প্লীজ স্যার। আপনার এদ্দিনের সাপ্ল্যায়ার আমি, আর একটা সুযোগ দিন। ত্যাঁদড় হলেও কয়েকটা সুপার-এফিশিয়েন্ট ভূত তৈরি করতে পেরেছি বুঝলেন। নিশিকান্ত বলে একটা ভূত...যখন প্রথম পাকড়াও করি তখন এক্কেরে হাবাগোবা ছিল। এখন ওই একটি ভূতে আপনার তিনশো রোবট চিৎপটাং হয়ে যাবে; না হলে গুরুপদ হালদারের নাম পাল্টে নেতুরাম রাখবেন'খন।

- দেখুন, আমি কথায় নয়৷ কাজে বিশ্বাস করি। ভূতের এফিশিয়েন্সি বেশি হলে, আপমার কমিশনও বাড়বে। কিন্তু আই ওয়ান্ট দেম ক্যুইক।

- হেহ্ হেহ্...হবে হবে। আচ্ছা চ্যাটার্জিবাবু,আপনার মনে পড়ে? এজ এখন ভূত লেবারদের নিয়ে যেমন টানাটানি, এককালে রোবটদের নিয়েও ইন্ডাস্ট্রিদের এমনই হ্যাংলামো ছিল? এখন আমাদের মত ভূত ট্রেনারদের যে অল্প ইয়েটিয়ে একটু হয়েছে, সে'কালে দেখতাম রোবট ম্যানুফ্যাকচারারদের কী সাংঘাতিক রোয়াব।

- ইট ইজ অল আ গেম অফ কস্ট মিনিমাইজিং গুরুপদবাবু৷ লেবারটেবার  এমনিতে পেটি ইস্যু। ইকনমিতে আসল খেল জমে ক্যাপিটাল আর কনসিউমারের মধ্যে। লেবার ব্যাপারটাকে মাথায় উঠতে দিলেই লায়াবিলিটি; তাদের এফিশিয়েন্সি হতে হবে গগনচুম্বী অথচ তাদের পিছিনে খরচ হতে হবে মিনিমাম। মানুষ শ্রমিকের হাজার বায়নাক্কা, তাই ইন্ডাস্ট্রি সোজাসুজি ও'সব হ্যাপা বাদ দিয়ে রোবটে চলে গেল।  কিন্তু সে'টাও তো এখন ইতিহাস, প্রায় মান্ধাতা আমলের ঘটনা। এ'টা তো আর টুয়েন্টি ফিফটি নয়, দিস ইজ আ নিউ ওয়ার্ল্ড। নিউ অর্ডার। ফ্যাক্টরিতে রোবটের চেয়ে ভূতের পিছনে খরচ অনেক কম, আর ভূতের বেগার খাটার ক্ষমতাও অনেক বেশি। রোবটদের মত ফিজিক্সের নিয়ম নিয়ে আদেখলামো নেই ভূতেদের মধ্যে আফটার অল৷ আমি আপনাকে লিখে দিচ্ছি গুরুপদবাবু, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে থেকে সমস্ত রোবট লেবার উবে যাবে, জাস্ট লাইক হিউম্যান লেবার। শুধু ভূতের বেগার খাটনিতে সমস্ত ইন্ডাস্ট্রি চলবে।

- এমনটাই তো প্রকৃতির নিয়ম৷ গতকাল ছিল রোবট, আজ আছে ভূত, আগামীকাল হয়ত অন্য কিছু এসে শ্রমিক সাজবে।

- ওই যে বললাম। কস্ট মিনিমাইজিং ইজ দ্য রিয়েল গেম গুরুপদবাবু। তাতেই গোবেচারা ক্যাপিটালিস্টদের সামান্য মুনাফা থাকবে আর নিরীহ কনজিউমারদের হাতে ডিসপোজেবল ইনকাম আর একটু বাড়বে। সে যাকগে...ইয়ে...আমি একটা রিউমর শুনেছি।

- গুজব? আজ্ঞে...কী রকম?

- এই গভর্নমেন্ট ইকনোমির ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। সদিচ্ছেও আছে৷ শুনেছি তাঁরা ভাবছে যে দেশের মধ্যে যাদের কনজিউমার হিসেবে র‍্যাঙ্ক সবচেয়ে নীচের দিকে, তাঁদের মধ্যে নাকি র‍্যান্ডম স্যাম্পেল সিলেক্ট করে কম্পালসরি সুইসাইড করানো হবে; প্রতি বছর। কোন বছর কত কম্পালসরি সুইসাইড করানো হবে সে'টা ডিপেন্ড করছে লেবার ডিমান্ডের ওপর। সুইসাইড করানো হবে স্ট্যান্ডার্ড ভূত জেনারেটিং প্র‍্যাক্টিস অনুযায়ী যাতে টপ কোয়ালিটি ভূত তৈরি করা যায়। আপনার তো সোর্স আর সর্ষে নিয়েই কাজ৷ আপনার কাছে কোনও খবর আছে? আপনার সোর্স কী বলে?

- ব্যাপারটা গুজব নয় চ্যাটার্জিসাহেব। খবরটা পাকা। সামনের সেশনেই পার্লামেন্ট বিলটা পেশ করবে মনে হয়। ইয়ে, এক্কেরে হাঁড়ির খবর৷ তবে এখনই পাঁচকান করবেন না যেন। সরকারবাহাদুর বুঝেছেন যে ভূতের সাপ্লাই না বাড়লে জিডিপির পক্ষে টগবগিয়ে ছুটে চলা সম্ভব নয়। 

- আপনার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক গুরুপদবাবু৷ নাহ্, গভর্নমেন্টের প্রশংসা করতেই হবে হোয়েন ইট ইজ ডিউ। হাড়হাভাতে লো-র‍্যাঙ্কিং কনজিউমারের বদলে যদি কিছু টেরিফিক কোয়ালিটির ভূত পাওয়া যায়; তাতে সত্যিই দেশের ও দশের মঙ্গল। কী বলেন?

- বটেই তো। বটেই তো।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু