Skip to main content

বৃষ্টি ও মাদুর


হুড়মুড় করে ঘরের উত্তর দিকের জানালাটা বন্ধ করার আগেই বিছানার অর্ধেকটা ভিজে গেল বৃষ্টির ঝাপটায়। কয়েক সেকেন্ডের বৃষ্টিতেই বালিশ তোষক সব সপসপে।

একরাশ বিরক্তি চেপে ধরেছিল অমিয়কে। একে অফিসের কাজের চাপে জেরবার অবস্থা, তারপর রোজ ফেরার পথে অটোর লাইনে হয়রানি, বাসের ভিড়ে ধ্বস্তাধস্তি আর বাড়ি ফিরে হাত পুড়িয়ে ভাতেভাত রান্না করা। শরীরে এতটাই ক্লান্তি নিয়মিত জমা হয় যে রাত্রে খাওয়া সেরে ফেলার পর টেলিভিশন বা গল্পের বইতে মন বসানোও দায় হয়ে পড়ে। বিছানায় গা এলিয়ে দিতে পারলেই যেন শান্তি। অথচ কয়েক মুহূর্তের অবহেলায় বিছানাটাই ভিজেটিজে মাটি হল। ধুত্তোর।  এই এক কামরার ঘর, ওই খাট আর মায়ের রেখে যাওয়া আলমারিটা বাদে আসবাব বলতে আর কিস্যুই নেই; সামান্য সোফাও নেই যে সে'খানে লম্বা হয়ে অমিয় রাতটা কাটিয়ে দেবে।

ক্লান্তি, ঘুম আর জিভে লেগে থাকা নিজের হাতে পোড়ানো ভাতের স্বাদ; সব মিলে অমিয়র যে কী বিশ্রী লাগছিল। কোনও রকমে মেঝেতে একটা চাদর পেতে শুয়ে পড়লে সে। 

নাইট ল্যাম্পের আবছা আলোয় দেওয়ালে টাঙানো মায়ের ছবিটার দিকে চোখ যেতেই বুকের ভিতর কেমন একটা চিনচিনে ভাব দলা পাকিয়ে উঠল অমিয়র। যদ্দিন মা ছিল, তদ্দিন এ সংসারে কেমন যেন সংসারের সুবাস লেগেছিল। মাসকাবারি ছিল, আলমারিতে ন্যাপথালিনের গন্ধ ছিল, এক চিলতে রান্নাঘরটায় পরিপাটি শান্তি ছিল। মায়ের ছবিটা থেকে চোখ সরিয়ে পাশ ফিরে শুলো অমিয়।

মেঝেয় পাতলা চাদর পেতে শোওয়া, কেমন যেন একটা কনকনে ছ্যাঁত অমিয়র গা বেয়ে উঠে আসছিল। সে দিব্যি বুঝছিল আজ রাত্রে আর কপালে ঘুম নেই। এমন সময় মোবাইলটা উঠল বেজে।

- হ্যালো।

- আমি।

-  মিনু, এত রাত্রে? কী ব্যাপার..।

- না মানে, তেমন কিছু না। 

- সব ঠিক আছে তো? তোর বর মেয়ে?

- আমার জন্য অত চিন্তা থাকলে নিজে ফোন করে আমার খবর নিতিস অমু।

- তাই বলে এই রাতবিরেতে...।

- জানি। কল করা উচিৎ নয়। শুধু ওই..।

- শুধু কী?

- আমাদের বিয়ে যে হয়নি তার দায় কিন্তু একা আমার নয় অমু।

- এদ্দিন পর সে'টা বলতে...এত রাত্রে..।

- এদ্দিন পর মাঝেরাতে ফোন করে সে'সব বাজে কথা বলতে আমারও ভারী বয়ে গেছে। তাছাড়া আমি বেঁচেছি তোর পাল্লায় না পড়ে। কিন্তু তুই পারলি কী করে রে মাসীমার মারা যাওয়ার খবরটা আমায় না দিতে? নেহাত গত মাসে পুলুদি ফোন করে জানালো...।

- আসলে আমি ভাবলাম..।

- তুই ভাবলি মিনু কোথাকার কে যে তাকে জানাতে হবে। যাক গে, বেশ করেছিস।  আর তুইই বা আমার কোথাকার কে রে অমু? কেউ না। এই ছেলেবেলা থেকে তোকে চেনাটাই হয়েছে দোষ। 

- কী যে তখন থেকে বলে চলেছিস..।

- শোন। গুগলে দেখলাম তোদের পাড়ায় প্রচণ্ড বৃষ্টি নেমেছে। জানালা খুলে হাওয়া খাওয়ার শখ নিশ্চয়ই এখনও যায়নি? আর সময়মত জানালার পাল্লা বন্ধ করার বুদ্ধিটুকুও নিশ্চয়ই তোর নেই৷ বুদ্ধি থাকলে কি আর তুই মেজকাকার দেওয়া অত ভালো চাকরীটা রিফউজ করতিস? যাক গে। আমার আর কী৷  তোর বিছানাপত্তরের ভিজেটিজে একাকার অবস্থা নিশ্চয়ই। এখন রাত কাটা ওই ড্যাম্প ধরা বাড়ির মেঝেয় শুয়ে। 

- না মানে...ইয়ে...।

- অবশ্য তুই লাটসাহেব তো। কতটুকুই বা নিজের বাড়ির আর মায়ের খবর রাখতিস। তোর মা যে আলমারির পিছনে মোটা মাদুরটা গুটিয়ে রাখতেন, সে খবর তো রাখিস না৷ সে খবর রাখলে তোকে মেঝেয় শুয়ে রাতভর ছটফট করতে হত না। দিব্যি মাদুরের ওপর শুয়ে আরামসে ঘুম দিতে পারতিস। সে'টুকু বলতেই এত রাত্রে...।

- তোর এই জ্যাঠামোগুলো এ'বার ছাড় মিনু। আমার মায়ের মাদুরের কথা আমার মনে থাকবে না, থাকবে তোর? নিজেকে ভেবেছিস কী তুই?

- না আসলে..।

- আমি জানিনা সে মাদুর কোথায় রাখা আছে? তুই ভাবিস কী আমায়? অফিসে দশটা লোক চরিয়ে খেতে হয় রে আমায়, নেহাত গবেট নই।

- শোন অমু...আমি কিন্তু..।

- শোন। এমন দুমদাম অসময়ে আর ফোন করিস না। জেনে রাখ; আজ মোটেও জানালা বন্ধ করতে আমার দেরী হয়নি।  দিব্যি বিছানায় পাশবালিশ জড়িয়ে বৃষ্টির আওয়াজ শুনতে শুনতে নাক ডাকছিলাম...মাঝখান থেকে তোর ফোন এসেই ঘুমে বিশ্রী ব্যাঘাত ঘটল..।

- সরি। রাখি।

- রাখ।

ফোন কেটে অমিয় সোজা চলে গেল আলমারিটার কাছে৷ 

কী আশ্চর্য,  সত্যিই আলমারির পিছনে যত্ন করে গুটিয়ে রাখা মায়ের সেই মাদুরটা। মেঝেয় মাদুর পেতে গা এলিয়ে দিতেই দু'চোখ ভেঙে ঘুম নেমে এল; আহ্, মায়ের গন্ধ।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

ব্লগ-বাজ

আর চিন্তা নেই । বাঙালিকে আর রোখা যাবে না । আর সামান্য (সম্ভবত কিঞ্চিত গোলমেলে ) কবিতা ছাপাবার জন্যে সম্পাদক কে তোল্লাই দিতে হবে না । আর প্রেমে লটরপটর হয়ে ডায়েরি লিখে প্রাণপাত করতে হবে না। পলিটিক্স কে পাবলিক-জন্ডিস বলে গাল দেওয়ার জন্য আর “প্রিয় সম্পাদক” বলে আনন্দবাজারের ঠ্যাং ধরতে হবে না। কেন ?  হোয়াই? বাঙালি ব্লগিং শিখে গ্যাছে যে। ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে শাণিত তলোয়ারের মত “ পোস্ট”-সমূহ জনতার ইন্টেলেক্ট এসপার-ওসপার করে দেবে ; হাতে-গরম গায়ে-কাঁটা। বাঙালি মননের নব্য জিস্পট ; ব্লগ-স্পট । কে বলে যে বাঙালি ব্রিগেডে বুক্তুনি দিয়ে আর ফুটবল মাঠে খেউড় করে খতম হয়ে গ্যাছে ? কে বলে যে বাঙালির ঘিলু কফি হাউসে ভাত ঘুমে মগ্ন ? বাঙালিকে একবার ব্লগখোর হতে দিন , সমস্ত অভিযোগ ভ্যানিশ হয়ে যাবে । পোপ থেকে পরশুরাম ; ডেঙ্গু থেকে মশাগ্রাম ; বং-ব্লগের দাপট রইবে সর্বত্র । বাঙালির সমস্ত আশা-ভরসা-জিজ্ঞাসা এইবারে ব্লগ মারফত্‍ পৌছে যাবে ট্যাংরা ট্যু টেক্সাস । তোপসে মাছের স্প্যানিশ ঝোলের রেসিপি কী ? বাঙাল-ঘটি মিল মহব্বত-হয়ে গেলে কি বাঙ্গালিয়ানা চটকে যাবে ? নেতাজী কি এখ

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু