Tuesday, July 2, 2019

চিঠি ও বেঞ্চি


বিলু,

চিঠিটা খুব মন দিয়ে পড়বি, কেমন?

প্রথমত, ফ্রিজে চার'দিনের রান্না রাখা আছে। আমি যদি চট করে না ফিরতে পারি তা'হলে ছোটমাসীকে ফোন করিস একটা, কেমন? ও তোকে আসানসোলে নিয়ে গিয়ে রাখবে কিছুদিন। (আর আমি যদি দু'দিনের মাথায় ফেরত চলেই আসি, তা'হলে তো সমস্যা মিটেই গেল)।

দ্বিতীয়ত, ব্যাঙ্কের খাতা, ইন্স্যুরেন্সের কাগজ আর বাড়ির দলিল আলমারির লকারে রাখা আছে। সঙ্গে আমার কিছু গয়না। সে'গুলো একটা ব্যাগে করে নিয়ে যাস আসানসোল যাওয়ার সময়, কেমন? 
(আর আমি যদি দু'দিনের মাথায় ফেরত চলেই আসি, তা'হলে তো সমস্যা মিটেই গেল)।

খেয়াল রাখিস কিন্তু।

বিলু, পড়াশোনাটা মন দিয়ে করিস। তোর বাবা নিজে পড়াশোনার মধ্যে ডুবে থাকা মানুষ ছিলেন, ওর মানটা রাখিস। আসানসোলে কত ভালো ইস্কুল আছে, সে'খানেই পড়বি না হয়। অবশ্য ছোটমাসী তোকে বড্ড স্নেহ করে, সে'খানে তোর অযত্ন হবে না। (আর আমি যদি দু'দিনের মাথায় ফেরত চলেই আসি, তা'হলে তো সমস্যা মিটেই গেল)।

ভেবেছিস আমি দুম করে কোথায় চলে যাচ্ছি? ভেবেছিস একেবারে আকাট পাগলামো? না রে বিলু, বিশ্বাস কর আমি পাগল নই। তোর বাবার ও'রকম দুম করে গায়েব হয়ে যাওয়াটা আমি মেনে নিতে পারিনি, সে'টা ঠিকই। কিন্তু বিশ্বাস কর...তোর মা পাগল নয়। নয়।

নাহ্, তেমন দূরে কোথাও আর যাব কই বল। আমি শুধু সম্বলপুরের সেই কোয়ার্টারে একবার ফেরত যাব রে। মনে পড়ে তোর? সেই সুন্দর জায়গাটা? কলোনির মধ্যে কত গাছগাছালি..পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট৷ সেই রাস্তায় তোর বাবা সাইকেলে চেপে ঘুরে বেড়াত...অফিস ফেরতা বাড়িতে এসে ছাত্র পড়াত। অবশ্য তুই তখন কত ছোট।

জানিস বিলু, লোকে আমায় যাই বোঝাক; আমি জানি তোর বাবা অমন হুঠ করে হারিয়ে যাওয়ার মানুষ নয়। সে'দিন রাত্রেবেলা...মানে ওই বছর দশেক আগে...আমি জানি সে'দিন ও ঠিক সেই বেঞ্চিটায় গিয়ে বসেছিল...। কত করে বারণ করলাম রাত্রেবেলা ওখানে গিয়ে না বসতে..সাতপুরনো ভাঙাচোরা বিবর্ণ কনক্রিটের বেঞ্চ। আশাপাশে ঝোপঝাড়। এমনিতেই ওই পোড়ো দিকে কখনও কেউ যেতই না৷ তোর বাবাটা একটা অকারণ ডানপিটে মানুষ; সে'দিন তাঁর ইচ্ছে হল সেই বেঞ্চিতে বসে সিগারেট খাওয়ার; ওই বেঞ্চি নাকি তাকে টানছে। কত করে বললাম, এত রাতে এ'সব পাগলামোর মানে হয় না কিন্তু কে শোনে কার কথা। হুশ করে বেরিয়ে গেল, কমলা রঙের ফতুয়া আর সাদা পাজামা পরে। সেই শেষ দেখা। আর ফিরলে না। থানাপুলিশ তো কম হল না, কিন্তু কিস্যুতে কিস্যু না।

আর কিছু হবেই বা কী করে বল? ও কি পালিয়েছে নাকি যে খুঁজলেই সমস্যার সমাধান হবে? আমি বারবার করে সবাইকে বললাম ও ওই বেঞ্চি থেকেই গায়েব হয়েছে, কেউ পাত্তা দিল না। পুলিশ তো উড়িয়েই দিল আমার কথা। বারবার বললাম, কলোনির কোণের ওই অপয়া বেঞ্চিটা একদিন আগেও ভাঙাচোরা রঙচটা চেহারায় ছিল...অথচ তোর বাবা গায়েব হতেই রাতারাতি সে ঝকঝকে নতুন হয়ে উঠল...আশেপাশের ঝোপঝাড় এক্কেবারে সাফ। এমন কী বেঞ্চির গায়ে রাতারাতি নতুন রঙের পোঁচও পড়ে গেল; কমলা ও সাদা। ও বেঞ্চি গোলমেলে রে বিলু, আর তোর বাবা পালায়নি..গায়েব হয়েছে...কিন্তু আমার কথা কেউ শোনে না যে। সবাই পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দেয় (তুইও কি তাই করবি?)।

যাক, আজ সে বেঞ্চি আমায় বড় টান দিয়েছে রে। এদ্দিন পর..এদ্দিন পর যদি তোর বাবার কোনো খবর পাই। আমি সম্বলপুর চললাম, কোম্পানি বন্ধ হওয়ায় সে কলোনিটা এখন মনে হয় প্রায় জনমানবহীন, কিন্তু সে বেঞ্চিটা কি নেই? নিশ্চয়ই আছে।

বিলু, আমি যদি আর না ফিরি...তুই একবার এসে সম্বলপুর কলোনির দক্ষিণ কোণের সেই বেঞ্চিটার সামনে দাঁড়াস, কেমন বাবু? মনে রাখিস, আজ নীল সুতির শাড়ী পরে বেরোচ্ছি; মনে রাখিস।
আসি। ভালোবাসা ও আশীর্বাদ।
ইতি মা।

***
মায়ের এই সাত বছর পুরনো চিঠিটা টর্চের আলোয় পড়তে পড়তে বিহ্বল বোধ করছিলেন বিপ্লব চ্যাটার্জি। সামনের ভাঙাচোরা বাঁধানো বেঞ্চিটার দিকে তাকিয়ে গা শিউরে উঠছিল তাঁর।

টর্চটা নিভিয়ে পকেটে রাখলেন তিনি, মায়ের চিঠিটা তখনও হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা। এদ্দিন পর কেন যে হঠাৎ সম্বলপুরে ফেরার ঝোঁক হল...। বেঞ্চিটার দিকে ফের তাকালেন তিনি। আজ পূর্ণিমা ; চাঁদের ধবধবে আলোয় বিপ্লব স্পষ্ট টের পেলেন যে বেঞ্চির গায়ের বিবর্ণ আধচটা রঙটা আদতে নীল।

আরও মিনিট দশেকের মাথায় ঝিমঝিমে মাথায় গিয়ে বেঞ্চিতে বসলেন বিপ্লব। জ্ঞান হারানোর আগে টের পেলেন বেঞ্চির নীল রঙ মুছে তা'তে সাদা সবুজের ছোপ লাগছে যেন; ততক্ষণে তাঁর গায়ের সবুজ হাফশার্ট আর সাদা পায়জামা ঘামে ভিজে সপসপ করছে।

No comments: