Skip to main content

ইন্ডিয়ান সামার


বই পড়ার পরপরই সে বইয়ের বিষয়ে দু'কথা বলতে গেলে যে'টা বড় সুবিধে সে'টা হল বইয়ের "ডিটেলস"গুলো টাটকা তাজা মাথার মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। রেফারেন্স টেনে কিছু বলতে সুবিধে হয়। কিছুদিন কেটে গেলে সেই "ডিটেলস"গুলো ফিকে হয়ে আসে, অন্তত আমার ক্ষেত্রে তা তো হয়ই। তবে বই শেষ হওয়ার পর কিছুদিন কেটে গেলে একটা ভালো ব্যাপারও ঘটে; প্রাথমিক উচ্ছ্বাস, চমক বা লেখকের ভাষাগত চমকের আবরণ ভেদ করে বইয়ের নির্যাসটুকু 'ইন্টারনালাইজড' হয়। বিশেষত নন-ফিকশনের ক্ষেত্রে; উচ্ছাসের বাষ্প সাফ করে নিজের বোধবুদ্ধির ফ্রেমে সে বইয়ের মূল বক্তব্যটা যাচাই করে নিতে খানিকটা সময় তো লাগেই।

মাসখানেক আগে শেষ করা 'ইন্ডিয়ান সামার' বইটার ডিটেলগুলো কিছুটা আবছা হয়ে এলেও, বইয়ে সাতচল্লিশের যে রাজনৈতিক টানাপোড়েন আর সংঘাতগুলো তুলে ধরা হয়েছে; সে'গুলো ক্রমশ মনের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। সে'দিক থেকে আমার কাছে এ বই ল্যাপায়ারের 'ফ্রীডম অ্যাট মিডনাইট'য়ের চেয়ে বেশি ইম্প্যাক্টফুল। অনেক বিষয় সম্বন্ধে আমাদের ধ্যানধারণা যে একেবারে 'কাঁচকলা' তা কিন্তু নয়; কিন্তু ইনফর্মড ওপিনিওন (কিছুটা বায়াস না থাকাটাও অবশ্য অবাস্তব) তৈরি করতে গেলে এ ধরনের বই অত্যন্ত কাজের।

বইয়ের কোন রেফারেন্স পয়েন্টগুলো মনের মধ্যে জেঁকে বসে আছে?

১। মোহনদাস গান্ধী। ভদ্রলোকের চারিত্রিক জটিলতাগুলো খুব যত্ন করে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। তাঁর সাংসারিক জীবনের ব্যর্থতাগুলো, তাঁর অতিধার্মিক বাতিকসমূহ, বিজ্ঞান বা মেডিকাল সায়েন্স বা টেকনোলজি সম্পর্কে তাঁর বিটকেল বিরক্তি; এ'রকম আরো বেশ কিছু গোলমেলে দিক বহু ক্ষেত্রে বারবার আলোচিত হয়েছে এবং এ বইতেও সে'গুলো সম্বন্ধে তথ্যের অভাব নেই। কিন্তু বেশ কিছু প্রকাণ্ড "ফ্ল" থাকা সত্ত্বেও, মোহনদাসের গুরুত্ব তাঁর অহিংসার থিওরি এবং প্র‍্যাক্টিকাল ডেমোন্সট্রেশনে। যে কোনো মতবাদের ক্ষেত্রেই, মাঠে নামলে দেখা যায় প্রচুর ফাঁকফোকড় রয়েছে, গান্ধীর ক্ষেত্রেও সে তর্ক চলতেই পারে। কিন্তু আধুনিক যুগে তাঁর অহিংসার স্ট্র‍্যাটেজির গুরুত্ব যে কী অপরিসীম, তা রীতিমতো খাতায়কলমে কন্টেক্সটুয়ালাইজ করতে পেরেছেন লেখক। অহিংসা যে হিংসার চেয়ে ভালো এবং ক্ষেত্র বিশেষে সুইসাইডাল; তা জানার জন্য পলিটিকাল অ্যানালিস্ট না হলেও চলবে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে অহিংসাকে সঠিক সময়ের অন্তত শ'খানেক বছর আগে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন মোহনদাস; ইতিহাস অন্তত এই প্রবল সত্যটাকে কিছুতেই পাশ কাটিয়ে যেতে পারবে না। এমন কী মোহনদাস নিজের প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক ব্যর্থতার মধ্যে দিয়ে অহিংসার 'স্ট্র‍্যাটেজিক' গুরুত্বর পক্ষে যে সওয়াল রেখে গেছেন, তার গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই। হাজারো ইডিওলজিকাল কলকারখানার পাশে মোহনদাস নিজের ল্যাবরেটরিতে চোয়াল শক্ত করে এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে গেছেন এবং সহজে তাঁকে নড়ানো যায়নি; স্রেফ সে জেদের মূল্যেই ইতিহাস তাঁর স্থান চিরঅমলিন। গান্ধীর সেই প্যারালাল 'ম্যানহ্যাটন প্রজেক্ট' সযত্নে উপস্থাপিত হয়েছে এ বইয়ে। আর হ্যাঁ, দেশভাগের সময় মোহনদাসের ভূমিকা কেন খানিকটা ওভাররেটেড; সে বিষয় নিয়েও বিশদে আলোচনা করেছেন লেখক।

২। জহরলাল নেহরু। বইয়ের অনেকটা জুড়ে রয়েছেন জহরলাল। ফটোফ্রেমের সাজানোগোছানো 'ফার্স্ট প্রাইম মিনিস্টার' শুধু নন, মানুষ, বন্ধু ও প্রেমিক জহরলালই এ বইয়ের মূল আকর্ষণ। ভদ্রলোকের পাঁচমেশালি দিকটা বিভিন্নভাবে স্পষ্ট করে তুলতে পেরেছেন লেখক। ব্রিটিশদের প্রতি রাগ থেকে ব্রিটিশদের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধাভক্তি ও ভালোবাসা, গান্ধীকে বাপের মত ভালোবাসা আবার গান্ধীর কিছু ধ্যানধারণা শুনে কেঁপে উঠে পাশ কাটিয়ে যাওয়া, রাজনৈতিক লোভের পাশাপাশি বেহিসেবী আইডিয়ালিজম; জহরলালের একটা বড় গুণ বোধ হয় তাঁর "এক্সট্রিম পয়েন্ট"গুলো এড়িয়ে মাঝামাঝি থাকতে পারায়। সেই মাঝামাঝি থাকতে পারার ভালো এবং গোলমেলে দিকগুলোর কথা চমৎকারভাবে বলা হয়েছে। এ বইয়ে গান্ধীর চেয়ে অনেক বেশি জায়গা জুড়ে আছেন নেহেরু,
তবু তাঁকে নিয়ে আমার এ কাঁচা লেখায় বেশি না ফেনিয়ে বলি; বইটা পড়ুন। নেহরুর অন্ধ ভক্তই হোন বা কট্টর বিরোধী ; এ বই অত্যন্ত দরকারী।


৩। "নেহরু গান্ধীর জন্য দেশভাগ হয়েছে"। যে কোনো অতি-সরল কথা তলিয়ে দেখাটা জরুরী। আজকাল আবার এ আলোচনাটা ফের গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এবং সে অভিযোগ হয়য় দুম করে উড়িয়ে দেওয়াটাও হঠকারী ব্যাপার হবে। কিন্তু আয়রনিগুলো স্পষ্ট করে বুঝতে গেলে এই বইয়ের জবাব নেই। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের পাল্লায় পড়লে মুসলিমদের সর্বনাশ হবে, মোটের ওপর এই থিওরিতে ভর দিয়ে সফল হয়ছিলেন জিন্নাহ। দেশভাগের সব দোষ 'নেহরু গান্ধী'র বলে গলা ফাটানো যায় বটে, কিন্তু অলটারনেটিভগুলো ঠিক কী কী ছিল? একটা মুসলিম রাষ্ট্রের পাশাপাশি হিন্দু রাষ্ট্র? কিন্তু তা'তে কি জিন্নাহর আশঙ্কায় শিলমোহর পড়ত না? আর যারা সেকিউলার দেশ চেয়েছেন, তাঁরা নেহেরুর জায়গায় ঠিক কী কী অন্যভাবে করলে দেশের ও দশের বাড়তি উপকার হত? আমি আমার নড়বড়ে লেখায় গুলিয়ে দিয়ে থাকতে পারি, কিন্তু এ বইতে লেখক মজবুতভাবে এ'সব প্রশ্নের মোকাবিলা করেছেন এবং পাঠককে যত্ন করে গাইড করেছেন।

৪। এডউইনা ও ডিকি মাউন্টব্যাটেন ( এবং জহরলাল)। মশলা ব্যাপারটা লেখক এড়িয়ে যাননি বা যাওয়ার চেষ্টা করেননি। কিন্তু লজিক এবং কমনসেন্সকে জলাঞ্জলি না দেওয়ায় যে'টা হয়েছে সে'টা হল গসিপের বাইরে গিয়ে এদের তিনজনের সম্পর্কের প্লেটনিক দিকগুলো ফুটে উঠেছে; স্পষ্ট হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক ইকুয়েশনের পাশাপাশি এই সম্পর্কের অভিপ্রেত বা অনভিপ্রেত ফলাফলগুলো।
ডিকি মাউন্টব্যাটেনের যাবতীয় সাফল্য ও ব্যর্থতার নিয়ে বিস্তারিত ব্যালেন্সশিট সাজিয়ে বসেছেন লেখক; বিশেষত ভারতবর্ষের নিরিখে। সে ব্যালান্সশিট যেমন চিত্তাকর্ষক, তেমনই জটিল। তবে সে জটিলতার বর্ণনা দিতে গিয়ে পাঠককে ব্যতিব্যস্ত করে তোলেননি লেখক।
আর রয়েছেন এডউইনা। আমাদের দুর্ভাগ্য যে সে সময়ের রাজনৈতিক চরিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম একজনকে আমরা শুধু গসিপের মাত্রায় চিনি। এডউইনার সেই রাজনৈতিক ভূমিকা সযত্নে খোলসা করেছেন লেখক। অবশ্য এ বইয়ের পরিসর থেকে এডউইনার প্রেম ও প্রেমিকরাও বাদ পড়েননি। নেহরু আর এডউইনার সম্পর্কটা ঠিক কীরকম ছিল? লেখক এ বইতে সমস্ত 'পাবলিক ফ্যাক্টস' সোজাসাপটা ভাবে সাজিয়েছেন; এবং আলোচনা করেছেন যুক্তি এবং কমনসেন্স দিয়ে যাতে ব্যাপারটা গসিপে-গুবলেট না হয়ে যায়। তাঁদের সম্পর্কের রাজনৈতিক প্রভাবগুলোকেও খতিয়ে দেখা হয়েছে।
সবচেয়ে বড় কথা, সমস্ত সস্তা মশলার লোভ কাটিয়ে, নেহরু, ডিকি ও এডউইনা; এই তিনজনের বন্ধুত্ব ও আভ্যন্তরীণ সম্পর্কের উষ্ণতাটুকুর ওপর ফোকাস করেছেন লেখক। এ জন্য সাধুবাদ প্রাপ্য তাঁর।

৫। মহম্মদ আলী জিন্নাহ। তাঁর আশঙ্কাগুলো, তাঁর পরিকল্পনাগুলো, নেহরুর সঙ্গে লড়া ডুয়েল এবং তাঁর মিইয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলো। সে'গুলো ছুঁতে পেরেছেন লেখক। জিন্নাহর ব্যাপারে আরো বিশদে পড়ার ইচ্ছে তৈরি হয়েছে বৈকি।

এ'ছাড়া, প্রতি পরিচ্ছেদে রয়েছে অসংখ্য টানটান ঘটনা ও গল্পের উল্লেখ; যা পাঠককে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গ্রিপ করে রাখবেই।
মোটের ওপর, যাকে বলে; "স্ট্রংলি রেকমেন্ডেড"।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু