Skip to main content

প্ল্যানচেট

ফতুয়ার ওপরের বোতামটা খুললেন  অনিমেষ। হাওয়াই চটি জোড়া খুলে হাতে নিলেন। পাজামাটা হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে নিলেন। ভেজা বালির ওপর দিয়ে হেঁটে গেলেন ছপাতছপ ঢেউয়ের দিকে। গোড়ালি ডোবা জলে এসে দাঁড়ালেন। ঢেউয়ের ঝটপট আর বুকে মুখে ঝড়ো হাওয়া এসে মনটা ঠাণ্ডা করে গেল। আজ অমাবস্যা। আকাশে হয়তো মেঘও রয়েছে, একটাও তারা নেই। এ অঞ্চলটা মূল শহরতলির ভিড় থেকে বেশি কিছুটা দূরে। কাছের রাস্তাতে লোকজন কেউই নেই। অনিমেষের হোটেলও অন্তত আধ কিলোমিটার দূরে, মাঝে পুরোটাই ফাঁকা। রাত্রের কালোতে শুধু সমুদ্রের ঢেউয়ের বুকের সাদা ফেনাটুকু দেখা যায়। পায়ের তলায় বালি সরে যাওয়ার ভালো লাগা শিরশিরানি। সব মিলে ভালো না লাগার কোন উপায় নেই। পাহাড়ের গুণ হল সে শ্রোতা। কিন্তু সমুদ্র আগ বাড়িয়ে দু’টো কথা নিজে বলে যায়। অন্ধকার আজ এতটাই নিকষ যে ঘড়ি দেখতে পারলেন না। মোবাইল ফোন জ্বেলে সময় দেখলেন অনিমেষ, রাত পৌনে দু’টো। এপ্রিলের রাত্রি হলেও, গভীর রাতের সমুদ্রের ধারালো হাওয়া সত্তর বছরের চামড়ায় বিঁধতে বাধ্য। কিন্তু আজ কোন কিছুই পরোয়া করার সময় নয়। অনিমেষের ভীষণ ভালো লাগতে আরম্ভ করেছিল। ভীষণ। কতদিন পর সে গোপালপুর এলে। শেষ এসেছিল বছর দশেক আগে। তখনও অপলা সাথে ছিল।

অপলাকে বাদ দিয়ে এই দু’তিন বছর যেভাবে কাটলো, তা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। অনিমেষের আফসোস হচ্ছিল যে এতদিন কেন গোপালপুর আসা হয়নি। বুকের অস্বস্তিটা এক ধাক্কায় অনেকটা কমে গেল।

**

অপলা এলো অন্তত আধ ঘণ্টা পরে। মৃণালবাবু ঠিক যেমন ভাবে অনিমেষকে গাইড করেছিলেন সে পদ্ধতিতেই কাজ হল। অনিমেষের বৃথাই এতদিন ধারনা ছিল যে প্ল্যানচেট মানেই সেটা বদ্ধ ঘরে মোমবাতি জ্বেলে করতে হবে। মৃণালবাবু কাছে তিনি চিরকৃতজ্ঞ থাকবেন। পেশায় ইনস্যুরেন্স এজেন্ট হলেও, এই মৃণালবাবুর এলেম আছে এসব ব্যাপারে। গোপালপুরে অমাবস্যা দেখে আসার আইডিয়াটাও তারই দেওয়া। তার সাথেই গোপালপুরের এই নির্জন কোণে এসে হোটেল ভাড়া করেছেন দিন তিনেক আগে।  
আর এই বেয়াড়া রাতে সমুদ্রে পা ডুবিয়ে অনিমেষ অসাধ্য সাধন করতে পারলেন। প্ল্যানচেট অনেকদিন ধরে চেষ্টা করছিলেন তিনি। অপলার জন্যেই। গোপালপুরে এসে একবারেই হল।
নিজের মধ্যে অপলার গন্ধ টের পাচ্ছিলেন তিনি। অনিমেষের মধ্যে যে কী আনন্দ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল সমুদ্রের ভেজা বালিতেই শুয়ে পড়তে। কিন্তু মনঃসংযোগ এদিক ওদিক হতে দেওয়া যাবে না। সমুদ্র আর আকাশের জমাট বাঁধা কালোর পোস্টারে মুগ্ধ হয়ে পড়ছিলেন ক্রমশ তিনি। অপলা এসেছে। সে আছে পাশে। আজ কতদিন পর। আত্মাকে চুমু খাওয়া যায়?
-   “না যায় না”, চমকে উঠলেন অনিমেষ। কথাগুলো তার মুখ থেকেই বেরোলো কিন্তু তিনি টের পাচ্ছিলেন যে কথাগুলো তার বলে দেওয়া নয়। কেউ তার মনের কথা পড়ে ফেলে তারই কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে তাকে উত্তর দিচ্ছে। কেউ বলা অবশ্য ঠিক নয়, এ অপলাই। অর্থাৎ তাকে মনে মনে প্রশ্ন করে দেতে হবে, অপলা অনিমেষের স্বরেই অনিমেষকে উত্তর দেবে।


**

-   একটা কথা জিজ্ঞেস করবো অপলা?
-   অনেক কথা তো জিজ্ঞেস করলে। এবার যেতে দাও আমায়। আসি।
-   আর একটু থাকো প্লিজ। আর একটু। কতদিন পর...
-   আমার কষ্ট হচ্ছে তোমার মধ্যে অনিমেষ ।বোঝার চেষ্টা কর। সবকিছু আর আগের মত নেই।
-   আচ্ছা আর একটা কী দু’টো প্রশ্ন। প্লীজ অপলা।
-   বলো। তাড়াতাড়ি বল অনিমেষ।
-   তুমি গলা টিপতে পারো?
-   কী?
-   গলা। টিপতে পারো?
-   কেন বলতো?
-   আমাকে তোমার সাথে টেনে নাও অপলা। একা আর পারছি না। তোমায় ছাড়া পারার কথাও ছিল না। প্লীজ অপলা।
-   কিন্তু অনিমেষ...
-   কোন কিন্তু নয় অপলা...তুমি পারো কী না বলো...গলা টিপতে...
-   তুমি আসবে আমার সাথে অনিমেষ?
-   প্লীজ অপলা...প্লীজ...

**

নিজের হাত দু’টো হঠাৎ কনকনে ঠাণ্ডা এবং বিকট ভাবে শক্ত হয়ে তার নিজের গলাতেই সাঁড়াশির মত চেপে বসলো। উদ্ভট কষ্ট আর একটা চাপা আনন্দে অনিমেষ ভেসে গেলেন।

**

সমস্ত সন্দেহ এড়াতে মৃণালবাবুকে কম বেগ পেতে হয়নি। অনিমেষবাবুর কোটি টাকার ইন্স্যুরেন্সে নিজেকে গোপনে নমিনী হিসেবে ঢোকানোও মামুলি কাজ ছিল না, অনেক আটঘাট বেঁধে করতে হয়েছে।
কলকাতায় খুন করার প্রশ্নই ছিল না। অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে অনিমেষবাবুকে কলকাতার বাইরে আনতে হয়েছিল। মৃণালবাবুর কাছে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল অনিমেষবাবুকে বোঝানো যে তিনি প্ল্যানচেটে পারদর্শী। আর তার চেয়ের বড় হ্যাপা ছিল অনিমেষবাবুকে বুঝতে না দেওয়া যে আদতে হিপনোটিজ্‌ম তার বাঁয়ে হাত কা খেল এবং হিপনোটিজ্‌মে অসাধ্য সাধন করা সম্ভব।

Comments

kingkhan said…
Durdanto. Satyajit Roy ke mone korie dile.. Keya baat.
malabika said…
এটাকে ষড়যন্ত্র-সিরিজ বলাই উচিত ছিল।
রবি ঘোষের বাঘাকে মনে পড়ে গেল। গলা মোটা করে জেলের মধ্যে সে ডায়লগটা, "গানখানা ( গল্পখানা ) বড় ভাল বেঁধেছ হে "।
Unknown said…
দারুন হয়েছে।
Unknown said…
দারুন হয়েছে।
Aniruddha said…
Asombhob sundor!!

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু