Skip to main content

ধর্ম

ধর্ম অনেকক্ষণ ধরে উসখুস করছিল। অনেকক্ষণ ধরে। একটা চাপ ধরা অস্বস্তি। একটা দমবন্ধ করা বুক চিন্‌চিন্‌ তার পিছু ছাড়ছিল না।ঘামতে শুরু করায় পরনের টিশার্টটা খুলে রেখেছিল। নিশ্বাস ঘন হয়ে আসছিল ধর্মর। মনে হচ্ছিল যেন একটু তাজা হাওয়া গায়ে লাগলে ভালো লাগতো। কিন্তু মন চাইলেও জানলা খোলার উপায় ছিল না। হাজার হাজার ফ্যানের চোখ, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ-বাল্ব তার ঘরের দিকে অনবরত তাক করা আছে। সেলিব্রেটি হয়ে থাকার মাশুল যে কী সাঙ্ঘাতিক। চরসের রসও আজ শরীরকে তাজা করতে পারছিল না। ধর্মর চোখ ছলছলে হয়ে আসছিল বার বার। আবছায়া ঘরেও কালো চশমায় চোখ ঢেকে বসেছিল সে; পাছে আচমকা আয়নায় নিজের চোখ দেখে ফেলতে হয়। 

সাহস হয় না আজকাল নিজের চোখের দিকে তাকাতে। 

কান ফাটানো শব্দে ঘরের মোবাইলটা বেজে উঠলো। ধর্ম টের পেল যে তিন নম্বর ম্যানেজারের ফোন। এই ম্যানেজারদের কাঁধে ভর দিয়েই চলার অভ্যাস করে ফেলেছিল ধর্ম; সেলিব্রেটিদের তেমন ভাবেই কাটাতে হয় জীবন। ধর্ম যে ভাবে পা ফেলবে, হাসবে, কথা বলবে, আদর করবে; পাবলিকে সেটাই আঁকড়ে ধরবে। কাজেই প্রত্যেকটা পা ফেলা, প্রত্যেকটা হাসি ধর্মকে সাহস অত্যন্ত হিসেব করে ফেলতে হয় এবং সে হিসেবটুকু কষে দেয় তার ম্যানেজারেরা। কারণ ধর্ম বোঝে যে তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত রেভিন্যুর উর্বর উৎস। 
সমস্তই ঠিকঠাক চলছিল। দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে চলছিল। ধর্মর প্রত্যেকটা সৃষ্টি তার ভক্তদের মধ্যে আগুনের মত ছড়িয়ে পরে, ভালো খারাপের বিচারে আর আটকে থাকে না ধর্মের সৃষ্টি। সে এখন হট-সেলিং। তার নাম লেখা টিশার্ট, টুপি কোকাকোলার মতই পপুলার। ধর্ম জানে যে তার ম্যানেজাররা শুধু তার ডিজিটাল অটোগ্রাফ বেঁচেই অগুনতি টাকা আয় করে। বেশ কাটছিল জীবন ম্যানেজারদের সাথে। হঠাৎ আজকে ম্যানেজারদের ফোন আর নিতে ইচ্ছে করছিল না ধর্মর। ধর্মর ইচ্ছে করছিল পরমার সাথে কথা বলতে। পরমা কী এখনও দূরেই থাকতে চায় ?  
পথ চলার শুরুর দিনগুলো ধর্মের মনে আবছা হতে শুরু করেছিল। সেই সময়টা তার মনে অস্পষ্ট হতে শুরু করেছিল যখন সে সাইকেলে ঘুরতো। পরনে আকাশী ফতুয়া। পিঠের ব্যাগে কবিতার খাতা। ঘাসে সাইকেল শুইয়ে রেখে পরমার কোলে মাথা রেখে ঘাসের ডগা চিবুতে চিবুতে কবিতা আউরে চলা।  ধর্ম কবি হতে চেয়েছিল, কিন্তু কি ভাবে যেন কারখানা হয়ে পড়লো। কী ভীষণভাবে ব্যবসার গ্রাসে পড়ে গেল ধর্মের কবিতা। “বড্ড টাকা মা, বড্ড টাকা, বড্ড কষ্ট”। ককিয়ে উঠছিল আজ ধর্ম। মাদক ভরা সিগারেটে একের পর এক জ্বালিয়েও জ্বালা জুড়চ্ছিল না। ধর্মের ইচ্ছে হচ্ছিল মাথার চুল খামচে ধরতে। 

শেষ সিগারেটটা দু’টান দিয়েই ছুঁড়ে ফেলে দিল ধর্ম। মোবাইলটা হাতে নিয়ে ডায়াল করলে সে। 
- হ্যালো, পরমা...
- ধর্ম, কতবার বলেছি তোমায় যে তুমি আর আমায় ফোন করবে না!  
- পরমা প্লীজ...
- তোমার সাথে কথা বলতে আমার এতদিন বিরক্ত লাগতো। কাল থেকে ঘেন্না হচ্ছে ধর্ম। স্টপ কলিং মি আপ। 
- পরমা আমার কথা শোন...
- একটা নির্মম খুনির কথা শুনতে হবে আমায়? আমি বার বার শিউরে উঠছি এই ভেবে যে কোন একদিন আমি তোমার হাত ধরার স্বপ্ন দেখেছিলাম...
- পরমা কালকের খুনটা আমি করিনি...কোনও খুনই আমি করিনি...প্লিজ...
- নিজের মিথ্যেকে সত্যি বলে বিশ্বাস করার অভ্যাসটা বেশ আয়ত্ত করে ফেলেছ, তাই না ধর্ম?
- পরমা তুমি জানো খুন আমি করিনি।
- একের পর এক ক্রিটিককে তুমি খুন করেছ ধর্ম। তোমার কাজের নিন্দে যেই করেছে, তাকেই থেঁতলে দিতে চেয়েছ তুমি। আর দিয়েওছো কতজনকে। থেঁতলে। যেমন ওই নির্ভীক মানুষটাকে তুমি কুপিয়ে খুন করালে কালকে। সে তোমার শিল্পকে নিয়ে প্রশ্ন তোলার সৎ সাহস রেখেছিল  বলে।
- স্টপ ইট পরমা। আমি খুন করিনি। আমার কোন এক উন্মাদ ফ্যান এই সব...
- উন্মাদ? ওই উন্মাদদের কাঁধে চেপেই তোমার ব্যবসা চলে ধর্ম। মুনাফাটা চেটে নিয়ে নিজেকে আলাদা করে সাধু সেজে আর কতদিন ধর্ম? আর কতগুলো প্রাণ? আর কতগুলো পাপ তুমি তোমার পাগলাটে ফ্যান বা বাজে ম্যানেজারের ঘাড়ে চাপিয়ে নিজে পাশ কাটিয়ে যাবে ধর্ম? ছিঃ। তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে আমার ঘেন্না লাগে। আর পারলে আমার এই ঘেন্নার কথা তুমি তোমার ভক্তদের জানিয়ে দাও, আজ দিনের শেষে আমার লাশটাও গিফ্‌ট র‍্যাপ হয়ে তোমার কাছে পৌঁছে দেবে তোমার ভক্তরা। 

**

ধর্ম বুঝতে পারছিল সমস্তটাই গোলমাল হয়ে গেছে। সমস্তটাই। সাফল্য গলার টুঁটি টিপে ধরেছে, আর ফেরার পথ নেই। পরমা ভীষণ দূরে চলে গেছে। আর কোনদিন হয়তো প্রেমের ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারবে না ধর্ম। 
হাড়িকাঠে কাটা পাঁঠার মত ছটফট করছিল ধর্ম। বড্ড দেরী হয়ে গেল। বড্ড দেরী। 

ড্রয়ার থেকে রিভলভারটা বের করে নিজের মুখে গুঁজে দিলে ধর্ম।         


**

Comments

Anonymous said…
Yes all free thinker would cry with anger and pain... kinto bhai ekjon sipai shaheed holey bidroho thamey na... ae bidroho cholche ebong aa jibon cholbe.... keep blogging my dear friend!!

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু