Sunday, January 28, 2024

বিকেলের জানালা



জানালাটার সামনে মিনিট চারেক দাঁড়িয়েছিলেন অনন্ত৷ নিরবিচ্ছিন্ন ফোকাস নিয়ে সে জানালাটাকে গিলে খাওয়ার চেষ্টা করছিলেন মাঝবয়েসী ভদ্রলোক। কাঠের পাটা পর পর সেঁটে চৌকো জানালাটা মজবুত ভাবে আঁটা। ও জানালায় ঠোকাঠুকি করলেও কেউ সাড়া দেবে না।

এ জানালা চিরকাল এমন কেঠো-মড়া হয়ে পড়ে ছিল না৷ এককালে এ জানালায় জোড়া পাল্লা ছিল, নীল রঙ করা। সে পাল্লা খুললে দেখা যেত লম্বা লোহার শিক, রঙ না করা। তারে ঝোলানো সস্তা কাপড়ের পর্দা; সে'টার রঙ আর ডিজাইন ছ'মাসে ন'মাসে পালটে যেত। ওই জানালা ঘেঁষা একটা টেবিল ছিল। টেবিলের ওপর বইখাতার অগোছালো স্তুপ। অজস্র পড়ার বইয়ের আনাচেকানাচে কয়েকটা কমিক্স, দু-তিনটে গল্পের বই আর কিছু স্পোর্টসস্টার পত্রিকার কপি৷ সেই স্পোর্টসস্টার উল্টেপাল্টে দেখলে টের পাওয়া যেত পত্রিকার বিভিন্ন পাতায় নির্বিচারে ব্লেড চলেছে, উড়ে গিয়েছে বিভিন্ন ছবি। বলাই বাহুল্য, সিলেবাসের বই-খাতা -পেন্সিলবাক্সের চেয়ে কদর বেশি ছিল সেই জঞ্জালগুলোর। 

দুপুর যখন গা-ছমছমে ভাবে নিরিবিলি,  তখন একটা টিঙটিঙে স্কুলপড়ুয়া টেবিলে থুতনি রেখে নানা রকমের অদরকারি কাজ আর পড়াশোনায় মন দিত। সেই দরকচা মারা জীবনে এক্সেলেন্সের স্পর্শ বলতে ছেলেবেলার ওই বিকেলগুলোই। কমিক্স, গল্পের বই, আর খেলার পত্রিকার মধ্যে ঘুরপাক খেত অজস্র দুপুর।

কিন্তু ওই নিয়মিত দুপুর-সাধনাগুলো আদতে ছিল অপেক্ষা। বিকেলের অপেক্ষা৷ দুপুরের আলো সামান্য নরম হলেই জানালার পাল্লায় বেজে উঠবে;
টট টাক-টট টাক-টট টাক-টট টাক-টট টাক। সেই একই সুরে, রোজ : ভট্টাইয়ের ডাক৷

পিলু সে ডাক শুনে হুঠ্ করে টেবিল ছেড়ে উঠবে৷ খটাস করে জানালার পাল্লা দু'টো খুলে যাবে। ওই জানালার পাল্লা খুলে ঘরে আলো টেনে নেওয়াটাই পিলুর "আসছি, দাঁড়া" বলা। এরপর দু'টো সাইকেল কচরমচর করে সেই জানালার খোলা পাল্লার পাশ দিয়ে হুশ্ করে বেরিয়ে যাবে। ওই ম্যাজিকটুকু না ঘটলে সে জানালায় বিকেল আসত না।

অনন্তবাবু জানেন জানালার ও'পাশে বা এ'পাশে আর কেউ বিকেলের অপেক্ষায় বসে নেই৷ বিকেলও আর সে জানালায় আটকে নেই। কাজেই মিনিট চারেকের বেশি সে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকার কোনও মানেই হয় না।

No comments: