Tuesday, January 2, 2024

অ্যাস্ট্রনট অরবিন্দ চৌধুরীর ল্যান্ডিং



স্পেস-ক্র্যাফট ল্যান্ড করেছে আড়াই ঘণ্টা আগে। এক্কেবারে মাখনের মত ল্যান্ডিং, অ্যাস্ট্রনট অরবিন্দ চৌধুরীকে সামান্য বিষমও খেতে হয়নি। বেশ চনমনে মেজাজে ককপিটের মধ্যে খানিকক্ষণ ইউরেকা-মারদিয়াকেল্লা-উরিউরিবাবা-কীদারুণ বলে নাচানাচি করবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু স্পন্ডেলাইসিসের জ্বালাতনের কথা ভেবে লাফালাফির ব্যাপারটা বাদ দিলেন চৌধুরীবাবু। স্পেস-ক্র্যাফট নেভিগেশন কনসোল স্পষ্ট বাতলে দিচ্ছে যে ল্যান্ডিং একদম খাপেখাপ হয়েছে। তিনি এসে পড়েছেন গ্রহ কোড ৩৪৩৩ বাই ৩২৯২-তে, এই গ্যালাক্সির নাম উরগেন। পৃথিবী থেকে উড়ে আসতে সময় লেগেছে সতেরো মাস বাইশ দিন সতেরো ঘণ্টা উনিশ মিনিট তেত্রিশ সেকেন্ড। কলকাতা স্পেস সেন্টারে বসে হিসেব কষে যা দেখে গেছিল, তার থেকে রীতিমত আড়াই মিনিট কম। ফিরে গিয়ে একটা মেডেল-টেডেল পাওয়া যেতে পারে, কপালে থাকলে সরকারের থেকে কোনও বাহারে খেতাব আর তার পাশাপাশি স্পেশ্যাল বখশিশ হিসেবে মিক্সারগ্রাইন্ডার বা সরবতের গ্লাসের সেটও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু পৃথিবীতে সুখবরটা পাঠানোর আগে একটু এই নতুন গ্রহে নেমে হাঁটাহাঁটি করে নেওয়া দরকার। জরুরী কিছু ডেটা আর স্যাম্পল সংগ্রহ হয়ে গেলেই বাহাদুরির ব্যাপারটা স্পেস-সেন্টারে জানিয়ে দেওয়া যাবে'খন। লোকে জানুক, অরবিন্দ চৌধুরী এলেবেলে অ্যাস্ট্রনট নয়। হিসেব অনুযায়ী ঘণ্টা-চারেকেই কাজ সেরে ফেলা যাবে। তারপর স্পেস-ক্রাফটের সিঁড়ি গুটিয়ে দুগগা বলে বাড়ির দিকে রওনা হওয়া। বেরোনোর আগে গ্রহটার একটা নাম দিয়ে যেতে হবে। গিন্নীর অনারে এ গ্রহের নাম সুতপাস্ফেয়ার দেওয়ার ইচ্ছে অরবিন্দবাবুর। আশা করা যায় এই রোম্যান্টিক চমকের ফলে বিবাহবার্ষিকীর খরচ কিছুটা কমানো যাবে।

ফ্রুটজ্যাম আর পার্মাফ্রেশ পাউরুটির চার স্লাইস খেয়ে টেস্টিং আর স্যাম্পল কালেকশন কিট গুছিয়ে নিলেন অরবিন্দবাবু। এক্সিট ডোরের দিকে এগোনোর আগে এনভারোনমেন্ট-চেক মনিটরের দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ অবাক হতে হলও অরবিন্দবাবুকে। এ গ্রহের বাতাস-টাতাস যে অনেকটা পৃথিবীরই মত, বিজ্ঞানীদের হিসেব তেমনটাই আভাস দিয়েছিল বটে। এ অবশ্য নতুন কিছু নয়, আজকাল গোল্ডিলক কন্ডিশনস সমেত প্রচুর গ্রহেই পৃথিবীর মানুষ ইতিমধ্যেই পৌঁছে গেছে। বহু এলিয়েন প্রজাতির চোখ ধাঁধানো সভ্যতা সম্বন্ধে পৃথিবীর মানুষ এখন সবিশেষ ওয়াকিবহাল। এই উরগেন গ্যালাক্সির ৩৪৩৩ বাই ৩২৯২ গ্রহে যে কী সারপ্রাইজ অপেক্ষা করে আছে তা অরবিন্দবাবুর জানা নেই; তবে মনিটরের দিকে তাকিয়ে গ্রহের এ অঞ্চলের পলিউশন কাউন্ট দেখে চমকে যেতেই হলও; যেন অবিকল পৃথিবী।

তবে কি এই প্রথম মানবসভ্যতার কাছাকাছি কিছু নজরে পড়তে চলেছে? উফ্‌, ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়।

পিলে চমকানো কিছু আবিষ্কার করতে পারলে কালীঘাটে জোড়া পাঁঠা বলি দেবেন ফিরে গিয়ে, এমন প্রার্থনা করেই স্পেস-ক্র্যাফটের দরজা খুললেন অ্যাস্ট্রনট অরবিন্দ চৌধুরী। 

***

মিনিট দুয়েকের মধ্যে যেন একটা ঝড় বয়ে গেল। একের পর এক চমক। আর এক বিশ্রী আতঙ্ক যা বর্ণনা করার ভাষা অরবিন্দবাবুর জানা নেই।

স্পেস-ক্র্যাফটের দরজা খুলতেই অদ্ভুত কতগুলো জিনিস ধাক্কা দিল ভদ্রলোককে।

প্রথমত, গন্ধ। আলুর চপ, এগরোল, ঘাম, পারফিউম, আর ডিজেল পোড়া ধোঁয়ার ককটেল। এ ককটেল তার সুপরিচিত।

দ্বিতীয়ত, শব্দ। এ'খানেও রকমারি ব্যাপারস্যাপার; হাজার-হাজার মানুষের হইহই আর সে হইহইয়ের সিংহভাগই যে মোটা-দরের কলকাতাইয়া বাংলা, তা বলে দেওয়ার দরকার নেই। এমন কি মাইকে দু'বার ঘোষণাও শুনতে পেলেন; "বজবজ থেকে চোদ্দ বছরের বাপটু সান্যাল মেলায় এসেছেন ছোটদাদু হরিহর সান্যালের সঙ্গে। বাপটু হারিয়ে গেছে, ছোটদাদুর ধারণা বাপটু ছোটদাদুকে ফাঁকি দিয়ে ফুর্তি করে বেড়াচ্ছে। বাপ্টু তুমি যে'খানেই থাকো আমাদের কমিট অফিসের সামনে চলে এসো। তোমার ছোটদাদু রেগে বোম হয়ে এ'খানে পায়চারি করছেন"। দূরে ফাটা মাইকে কুমার শানুর গান ভেসে আসছে - "অমর শিল্পী তুমি কিশোরকুমার, তোমাকে জানাই প্রণাম"।  আর সব ছাপিয়ে; স্পেস-ক্রাফটের দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার মানুষের করতালি আর উল্লাস। পিলে চমকে কানে তালা লেগে অরবিন্দবাবুর সে এক বিশ্রী অবস্থা।

তৃতীয়ত, একটা হাড়-হিম করে দেওয়া দৃশ্য। অরবিন্দবাবু নিশ্চিত যে তার স্পেস-ক্র্যাফট এসে নেমেছে কলকাতার মিলন-মেলা প্রাঙ্গণে। নির্ঘাত মরশুমি আনন্দমেলা বসেছে। 

এত বড় ভুল হলটা কী করে? পকেট থেকে ইন্টার-গ্যালাক্টিক নেভিগেশনট্র্যাকার বের করে দেখলেন - কী আশ্চর্য, হিসেবে কোনও ভুল নেই। তিনি রয়েছেন উরগেন গ্যালাক্সির ৩৪৩৩ বাই ৩২৯২ গ্রহে। কিন্তু, এ'সব তবে কী?

ঠাহর করার আগেই অরবিন্দবাবু বুঝতে পারলেন যে মেলার ঠিক মাঝখানে এসে নেমেছেন তাঁর স্পেস-ক্র্যাফট। আর মেলা-কমিটির করিতকর্মা লোকজন একটা টিকিট কাউন্টার বসিয়েছে।  সর্বনাশ, লোকে লাইনে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে স্পেস-ক্র্যাফটে ঢুকবে বলে। চারজন ছোকরা ছেলে চোঙা হাতে ক্রমাগত চিল্লিয়ে যাচ্ছে; "আপনার ঠেলাঠেলি করবেন না। হাত টিকিট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকুন। শিগগিরি স্পেস-ক্র্যাফট ভ্রমণ শুরু হবে। লাইন ভাঙবেন না, লাইন ভাঙলেই টিকিট ক্যান্সেল। আর হ্যাঁ, দয়া করে মুড়ি বেগুনির ঠোঙা বা এগরোল হাতে স্পেস-ক্র্যাফটে প্রবেশ করবেন না। সেলফি নিতে গিয়ে অযথা ভিড় বাড়াবেন না"। 

গলা শুকিয়ে এলো অরবিন্দবাবুর। এ কী কাণ্ড! কিন্তু চট করে যে স্পেস-ক্র্যাফটে ঢুকে দরজা বন্ধ করবেন সে উপায়ও নেই, পা'দুটো একতাল লোহার মত ভারি। এমন সময় স্পেস-ক্রাফটের সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলেন এক মধ্যবয়স্ক হেডমাস্টার-গোছের এক ভদ্রলোক, বুকপকেটে ব্যাজ আঁটা, তা'তে লেখা, "অলোক হালদার, সভাপতি, কলকাতা আন্তর্জাতিক মেলা কমিটি। 

***

- আ...আ...আমি...।
- আপনি অ্যাস্ট্রনট অরবিন্দ চৌধুরী। ওয়েলকাম টু মিলন-মেলা প্রাঙ্গণ ইন কলকাতা, প্ল্যানেট পৃথিবীজ গ্রেটেস্ট সিটি।

- ইয়ে, আপনার কিছু ভুল হচ্ছে...অলোকবাবু। আমি এসেছি পৃথিবী নামক গ্রহের কলকাতা নামক শহর থেকে।

- হে হে। আপনি তেমনটা ভাবতেই পারেন। কিন্তু আমাদের কাছে আপনি এসেছেন গ্রহ কোড ৩৪৩৩ বাই ৩২৯২ থেকে।

- না না, সে'টা আপনাদের গ্রহের পোজিশন। আমাদের গ্রহ পৃথিবীর পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে।

- হে হে হে...আপনার কাছে যা সোজা, আমাদের কাছে তাই উলটো। অসুবিধে কীসের। তবে আপনার অনেক ধকল গেছে। আসুন, মেলা কমিটির অফিসে বসে বিশ্রাম নেবেন। আপনার জন্য ফাইভ স্টার অ্যাকোমোডেশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে সে'খানে। আর ইয়ে, আমাদের এমএলএ বিপিনবাবু আসছেন স্পেস-ক্র্যাফট বিলাসভ্রমণ উদ্বোধন করতে। তিনি খুব আগ্রহী আপনার সঙ্গে আলাপ করতে।

- আমার মাথাটা কেমন গুলোচ্ছে অলোকবাবু। আমি অ্যাস্ট্রনট। আমার অনেক কাজ। আর স্পেস-ক্র্যাফটে এত লোক ঢোকানোটা কি ঠিক হবে?

- ও মা! যে'দিন আপনি যাত্রা শুরু করলেন, সে'দিনই গোটা শহর জুড়ে পোস্টার পড়ে গেল। এ'সব ইন্টার-গ্যালাক্টিক মুভমেন্ট আমরা ট্র্যাক করে থাকি কিনা। আপনি এ পাড়ায় পায়ের ধুলো দেবেন খবর পাওয়ায় মেলা বসার পারমিশন হয়ে গেল। ইকনোমি বনবন করে ঘুরতে আরম্ভ করল। আপনি সময়মত এসে পৌঁছনোয় আমরা খুব খুশি।

- আমার মাথাটা বনবন করে ঘুরছে যে।

- ডোন্ট ওরি। মেলা তো ক'দিন মাত্র। ক'দিন না হয় রিয়েল কলকাতা উপভোগ করে যান।

- রিয়েল কলকাতা যে রিয়েল পৃথিবীতে রয়েছে অলোকবাবু।

- রিয়েল এ'টাই স্যার।

- এ তর্কের কোনও মানে হয়? এ'সব বাদ দিন। আমায় ফেরত যেতে হবে।

- আপনি ভয় পাচ্ছেন অরবিন্দবাবু। ভয় পাচ্ছেন সেই ভয়াবহ আবিষ্কারের। আপনার পৃথিবী আদত পৃথিবী নয়, আপনাদের কলকাতা আদত কলকাতা নয়; এ ধাক্কা যে মারাত্মক ধাক্কা। তবে মনখারাপ করবেন না। অলটারনেট কলকাতা তো এ দুনিয়ায় কম নেই। গত বারো বছেরো আপনি এ নিয়ে সাত নম্বর মক্কেল। এর আগের ছ'জন নাকে খত দিয়ে স্বীকার করে গেছেন যে আসল কলকাতা এ'খানেই। 


***

মেলা-কমিটির অফিসের সোফায় গা এলিয়ে পড়েছিলেন অ্যাস্ট্রনট অরবিন্দ চৌধুরী। তাঁর চোখমুখ পরিতৃপ্ত, ঠোঁটে এক রোমান্টিক হাসি। আনন্দমেলা দু'দিন আগেই শেষ হয়েছে। কিন্তু মেলা কমিটির আতিথ্যে কোনও ঘাটতি পড়েনি। অলোক হালদার নিজে এ'বেলা ও'বেলা তাঁর খোঁজখবর নিয়ে যাচ্ছেন। ফিরতে হবেই, কিন্তু অরবিন্দবাবুর বিশেষ তাড়া নেই। এ'খানকার ক্যালেন্ডারে এখন মার্চের সতেরো তারিখ। আর অরবিন্দবাবুর সামনের টেবিলে থরে থরে সাজানো খাঁটি হাইকোয়ালিটি এবং টাটকা নলেন গুড়ের সন্দেশ। যে পৃথিবীর কলকাতায় নির্ভেজাল নলেনের বাস বছরে সাড়ে চার মাস, তার পৃথিবীত্ব ও কলকাতাত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করাটা মুর্খামি; এ সত্য অস্বীকার করার ক্ষমতা অরবিন্দবাবুর নেই। হপ্তা-খানেক পর অরবিন্দবাবু ফিরে যাবেন গ্রহ ৩৪৩৩ বাই ৩২৯২-তে, যে'খানে সুতপা তাঁর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। স্পেস-ক্র্যাফটের কন্ট্রোলড পরিবেশে আদত কলকাতার কিলো দশেক টপ-ক্লাস নলেন সন্দেশ নিয়ে ফিরতে কোনও অসুবিধেই হবে না। বিবাহবার্ষিকীতে গিন্নীর জন্য এর চেয়ে ভালো উপহার আর কীই বা হতে পারে। 


(ছবিটা রেয়া আহমেদের আঁকা। বংপেন ৭৫-য়ের জন্য এ'টা আর আরো জমজমাট কিছু স্কেচ এঁকেছিল সে) 

No comments: