Skip to main content

প্রফেসর দত্তর শেষের লেখা

একটা পেল্লায় ক্লাসরুম, দেওয়ালের রঙ হালকা নীল। সারি-সারি বেঞ্চি, সমস্তই ফাঁকা। ক্লাসঘরের উত্তরের দেওয়ালে একটা ঢাউস কাচের জানালা, বিকেলের নরম রোদে ঝলমলে। সে জানালার উলটো দিকের দেওয়ালে একটা পেল্লায় ব্ল্যাকবোর্ড। তাঁর সামনে একটা সাদামাটা কাঠের টেবিল-চেয়ার। সে চেয়ারে বসে এক বৃদ্ধ, এক মাথা কাঁচাপাকা চুল, পাতলা ফ্রেমের চশমা। বয়স অন্তত সত্তর-বাহাত্তর। পরনে সাদা হাফশার্ট, কালো ট্রাউজার। এক মনে টেবিলের ওপর ঝুঁকে ডায়রিতে কিছু লিখে চলেছেন। শব্দ বলতে ক্লাসরুমের দেওয়ালঘড়ির টিকটিক আর বৃদ্ধের কলম-চালানোর খসখস।

তাঁর সামনে যে দাঁড়িয়ে, তাঁর পেটাই চেহারা, ইস্পাত-কঠিন মুখ। কিন্তু চোখে সামান্য অস্বস্তি, খানিকটা চঞ্চল বোধ হয়। সে ভদ্রলোকের গায়ে সামরিক পোশাক। 

দম-বন্ধকরা মিনিট দশেকের মাথায় দাঁড়ানো ভদ্রলোক সামান্য ঝুঁকে বললেন, "প্রফেসর দত্ত। সময় হয়ে এলো"।

"মেজর তেওয়ারি। হাতে এখনও সাড়ে পাঁচ মিনিট রয়েছে"। 

"তাই বলছিলাম...আপনি কারুর সঙ্গে কথা বলতে চান না প্রফেসর"?

"তা তো চাইই"। 

"আমার কাছে ফোন আছে। আপনি চাইলে..."। 

"একজনের সঙ্গে কথা বলে কী হবে মেজর? তার চেয়ে বরং এই ডায়েরিতেই লিখে রেখেছি শেষ কথাগুলো। ফোনে তো সেই একদু'জনকে ফোন বলা। এই ভালো। শেষ কিছু কথা তো, অনেকের কাছে পৌঁছক। এই ভালো"। 

"আপনার এ ডায়রির লেখাগুলো তো কারুর কাছে পৌঁছতে দেওয়া হবে না"।

"তবু। আপনার দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা পড়বেন। আপনাদের হাইকম্যান্ড পড়বে। চুলচেরা বিশ্লেষণ করবে। তা'তেই হবে"।

"আপনার পরিবার? বন্ধুবান্ধব"?

"তাদের আর নতুন করে কিছুই বলার নেই"। 

"ডায়রিতে নিশ্চয়ই বিপ্লব সম্বন্ধে নিজের মতামত লিখে রাখছেন প্রফেসর"?

"আমি ভারি মধ্যমেধার মানুষ মেজর তেওয়ারি। যা ঠিক মনে হয়, সে'টার হয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে পারি। যা ভুল মনে হয়, নিশ্চিন্তে সে'টার প্রতিবাদ করতে পারি। তবে কী, নিজের মতামতগুলোর সম্বন্ধে নিজেই এতটা ধন্ধে থাকি যে ঠিক-ভুল মাঝেমধ্যেই গুলিয়ে যায়। কাজেই বিপ্লব নিয়ে কিছু লিখে যাওয়ার দুঃসাহস আমার নেই"। 

"এ'বারে আর সত্যিই সময় নেই, প্রফেসর"।

"অলরাইট মেজর। চলুন, যাওয়া যাক"। 

"যাওয়ার তো কোথাও নেই প্রফেসর"। 

"ওহ্‌। সেই ভালো। এই ভালো। ক্লাসরুম ছাড়া আমার আর ঠাঁই হবেই বা কোথায়।

"আই অ্যাম সরি প্রফেসর"।

"মেজর তেওয়ারি। আমার ডায়রিটা আপনাকেই গছিয়ে যাই তা'হলে"।

"জানতে খুব আগ্রহ হচ্ছে...এত মন দিয়ে কী লিখে গেলেন"।

"এখনও তো মিনিট দুয়েক আছে। পড়ে দেখুন না। নেহাতই একটা অণুগল্প"। 

ঘড়ি দেখে মাথা নাড়লেন মেজর তেওয়ারি। প্রফেসরের হাত থেকে ডায়রিটা নিয়ে পেজমার্কটা সরিয়ে পড়তে শুরু করলেন মেজর।

পড়তে পড়তে, ক্রমশ গলা শুকিয়ে এলো ভদ্রলোকের। আরে! এ তো প্রফেসর দত্ত আর মেজর তেওয়ারির গল্প।

** প্রফেসর দত্তের ডায়রি থেকে**

একটা পেল্লায় ক্লাসরুম, দেওয়ালের রঙ হালকা নীল। সারি-সারি বেঞ্চি, সমস্তই ফাঁকা। ক্লাসঘরের উত্তরের দেওয়ালে একটা ঢাউস কাচের জানালা, বিকেলের নরম রোদে ঝলমলে। সে জানালার উলটো দিকের দেওয়ালে একটা পেল্লায় ব্ল্যাকবোর্ড। তাঁর সামনে একটা সাদামাটা কাঠের টেবিল-চেয়ার। সে চেয়ারে বসে এক বৃদ্ধ, এক মাথা কাঁচাপাকা চুল, পাতলা ফ্রেমের চশমা। বয়স অন্তত সত্তর-বাহাত্তর। পরনে সাদা হাফশার্ট, কালো ট্রাউজার। এক মনে টেবিলের ওপর ঝুঁকে ডায়রিতে কিছু লিখে চলেছেন। শব্দ বলতে ক্লাসরুমের দেওয়ালঘড়ির টিকটিক আর বৃদ্ধের কলম-চালানোর খসখস। 

তাঁর সামনে যে দাঁড়িয়ে, তাঁর পেটাই চেহারা, ইস্পাত-কঠিন মুখ। কিন্তু চোখে সামান্য অস্বস্তি, খানিকটা চঞ্চল বোধ হয়। সে ভদ্রলোকের গায়ে সামরিক পোশাক। 
এমন দম-বন্ধকরা মিনিট দশেকের মাথায় দাঁড়ানো ভদ্রলোক সামান্য ঝুঁকে বললেন, "প্রফেসর দত্ত। সময় হয়ে এলো"।

"মেজর তেওয়ারি। হাতে এখনও সাড়ে পাঁচ মিনিট রয়েছে"। 

"তাই বলছিলাম...আপনি কারুর সঙ্গে কথা বলতে চান না প্রফেসর"?

"তা তো চাইই"। 

"আমার কাছে ফোন আছে। আপনি চাইলে..."। 

"একজনের সঙ্গে কথা বলে কী হবে মেজর? তার চেয়ে বরং এই ডায়েরিতেই লিখে রেখেছি শেষ কথাগুলো। ফোনে তো সেই একদু'জনকে ফোন বলা। এই ভালো। শেষ কিছু কথা তো, অনেকের কাছে পৌঁছক। এই ভালো"। 

"আপনার এ ডায়রির লেখাগুলো তো কারুর কাছে পৌঁছতে দেওয়া হবে না"।

"তবু। আপনার দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা পড়বেন। আপনাদের হাইকম্যান্ড পড়বে। চুলচেরা বিশ্লেষণ করবে। তা'তেই হবে"।

"আপনার পরিবার? বন্ধুবান্ধব"?

"তাদের আর নতুন করে কিছুই বলার নেই"। 

"ডায়রিতে নিশ্চয়ই বিপ্লব সম্বন্ধে নিজের মতামত লিখে রাখছেন প্রফেসর"?

"আমি ভারি মধ্যমেধার মানুষ মেজর তেওয়ারি। যা ঠিক মনে হয়, সে'টার হয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে পারি। যা ভুল মনে হয়, নিশ্চিন্তে সে'টার প্রতিবাদ করতে পারি। তবে কী, নিজের মতামতগুলোর সম্বন্ধে নিজেই এতটা ধন্ধে থাকি যে ঠিক-ভুল মাঝেমধ্যেই গুলিয়ে যায়। কাজেই বিপ্লব নিয়ে কিছু লিখে যাওয়ার দুঃসাহস আমার নেই"। 

"এ'বারে আর সত্যিই সময় নেই, প্রফেসর"।

"অলরাইট মেজর। চলুন, যাওয়া যাক"। 

"যাওয়ার তো কোথাও নেই প্রফেসর"। 

"ওহ্‌। সেই ভালো। এই ভালো। ক্লাসরুম ছাড়া আমার আর ঠাঁই হবেই বা কোথায়।

"আই অ্যাম সরি প্রফেসর"।

"মেজর তেওয়ারি। আমার ডায়রিটা আপনাকেই গছিয়ে যাই তা'হলে"।

"জানতে খুব আগ্রহ হচ্ছে...এত মন দিয়ে কী লিখে গেলেন"।

"এখনও তো মিনিট দুয়েক আছে। পড়ে দেখুন না। নেহাতই একটা অণুগল্প"। 

ঘড়ি দেখে মাথা নাড়লেন মেজর তেওয়ারি। প্রফেসরের হাত থেকে ডায়রিটা নিয়ে পেজমার্কটা সরিয়ে পড়তে শুরু করলেন মেজর। আরে! এ তো প্রফেসর দত্ত আর মেজর তেওয়ারির গল্প। শুধু গল্পটা পড়তে শুরু করার আগে মেজর তেওয়ারি যে'টা টের পাননি, সে'টা হল প্রফেসর দত্তর কলমের কালিতে ছিল সাঙ্ঘাতিক বিষ। প্রফেসর খেয়াল করেছিলেন যে মেজর তেওয়ারির ডান হাতের আঙুলের তর্জনীতে সামান্য চোট রয়েছে, ডায়রির কালি ছোঁয়া সে'খানে লেগেছে। আর মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাপার।

***

ডায়েরি থেকে উদ্ভ্রান্তের মত মুখ তুললেন মেজর তেওয়ারি। টেবিলে উপুড় হয়ে পড়ে আছেন প্রফেসর দত্ত, কলমের নিবটা তাঁর মুখে পোরা।

চিৎকার করতে চেয়েও পারলেন না মেজর তেওয়ারি, চারপাশটা ঝাপসা হয়ে আসছিল। মুহূর্তের মধ্যেই কাচের জানালার ওপর থেকে পড়ন্ত বিকেলের রোদটুকু কেউ যেন হুট করে শুষে নিলো।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

ব্লগ-বাজ

আর চিন্তা নেই । বাঙালিকে আর রোখা যাবে না । আর সামান্য (সম্ভবত কিঞ্চিত গোলমেলে ) কবিতা ছাপাবার জন্যে সম্পাদক কে তোল্লাই দিতে হবে না । আর প্রেমে লটরপটর হয়ে ডায়েরি লিখে প্রাণপাত করতে হবে না। পলিটিক্স কে পাবলিক-জন্ডিস বলে গাল দেওয়ার জন্য আর “প্রিয় সম্পাদক” বলে আনন্দবাজারের ঠ্যাং ধরতে হবে না। কেন ?  হোয়াই? বাঙালি ব্লগিং শিখে গ্যাছে যে। ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে শাণিত তলোয়ারের মত “ পোস্ট”-সমূহ জনতার ইন্টেলেক্ট এসপার-ওসপার করে দেবে ; হাতে-গরম গায়ে-কাঁটা। বাঙালি মননের নব্য জিস্পট ; ব্লগ-স্পট । কে বলে যে বাঙালি ব্রিগেডে বুক্তুনি দিয়ে আর ফুটবল মাঠে খেউড় করে খতম হয়ে গ্যাছে ? কে বলে যে বাঙালির ঘিলু কফি হাউসে ভাত ঘুমে মগ্ন ? বাঙালিকে একবার ব্লগখোর হতে দিন , সমস্ত অভিযোগ ভ্যানিশ হয়ে যাবে । পোপ থেকে পরশুরাম ; ডেঙ্গু থেকে মশাগ্রাম ; বং-ব্লগের দাপট রইবে সর্বত্র । বাঙালির সমস্ত আশা-ভরসা-জিজ্ঞাসা এইবারে ব্লগ মারফত্‍ পৌছে যাবে ট্যাংরা ট্যু টেক্সাস । তোপসে মাছের স্প্যানিশ ঝোলের রেসিপি কী ? বাঙাল-ঘটি মিল মহব্বত-হয়ে গেলে কি বাঙ্গালিয়ানা চটকে যাবে ? নেতাজী কি এখ

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু