Skip to main content

মনোজবাবুর লেখালিখি

- কী রে, খুব ব্যস্ত নাকি?
- আরে, মনোজ। বাঁচালি ভাই। কদ্দিন ধরে ভাবছি কবে তুই আসবি। তা, একটা ফোন করে এলি না কেন? ইদানীং শ্যামলাল একটা নতুন ধরণের ডিমের চপ ভাজা শুরু করেছে। তবে সে'টার জন্য আগে থেকে কিমা আর কুচোচিংড়ি আনিয়ে রাখা দরকার।
- সে'সব গুরুপাক পরে হবে'খন। এখন আগে ওঁকে দু'কাপ চা করতে বল দেখি দেবু। জরুরী কথা আছে।
- দাঁড়া, এ'সময়টা শ্যামলাল একটা সিরিয়াল দেখে। এখন ওকে ডিস্টার্ব করাটা সমীচীন হবে না। দু'মিনিট বস, আমি চা বসিয়ে দিচ্ছি।
- না না, তুই বস বরং। আমার তো আর তাড়াহুড়ো নেই। জরুরী কথাটা আগে সেরে নিই।
- নভেলটা শেষ করেছিস মনে হচ্ছে?
- আজ সকালেই শেষ চ্যাপ্টারটা লিখলাম। জানিস তো আমায়, তোকে না শোনানো পর্যন্ত সোয়াস্তি পাচ্ছিলাম না।
- এক্সাইটিং। উফ, কদ্দিন পর গল্প পড়বি বলে এলি ভাই। আজ কিন্তু জমিয়ে আড্ডা হবে।
- আলবাত। তোর ফিডব্যাক ছাড়া তো আর প্রকাশকের কাছে পাঠিয়ে দেওয়াটা ঠিক হবে না।
- আমি আর সাহিত্যের কীই বা বুঝি। তবে তোর লেখার প্রতি আমার আগ্রহটা বরাবরই পার্সোনাল। বইটই তো নেহাত কম পড়ি না। তোর লেখা আমায় যে'ভাবে ইনফ্লুয়েন্স করে, মুগ্ধ করে...।
- দেখিস। আবার হেগিওগ্রাফি লিখতে বসিস না যেন।
- আরে কী যে বলিস। ইউ ডিজার্ভ ইট। তা'ছাড়া পশ্চিমবাংলায় তোর ভক্তদের সংখ্যা যে'ভাবে এক্সপোনেনশিয়ালি বাড়ছে, সে'টাই প্রমাণ করে যে তোর লেখার ডেপ্থ ঠিক কতটা। আর খামোখা প্রশংসা করার লোক আমি নই, জানিস তো ভাই। তোর জন্য আমার সত্যিই গর্ব হয়। আফটার অল, ক্লাসমেট বলে কথা।
- সে জন্যই তো তোর কাছে বারবার ছুটে আসি দেবু। হ্যাঁ, লিখেটিখে আজকাল একটু সুনাম হয়েছে বটে, তবে কী জানিস...।
- কী ব্যাপার বল তো। তোকে একটু ডিস্টার্বড মনে হচ্ছে?
- আমার বইপত্তর নিয়ে কাগজপত্রে আজকাল বেশ লেখালিখি হচ্ছে। প্রকাশকদের খাতির দিনদিন বাড়ছে। ভিড়ের মধ্যে মানুষজন চিনতে পেরে অটোগ্রাফের খাতা এগিয়ে দিচ্ছে।
- প্রতিপত্তি বাড়ছে, তাই ডিস্টার্বড?
- সত্যি কথা বলতে কী দেবু, সে'সব আমার ভালোই লাগে। লাইমলাইটে থাকতে কে না চায়...কিন্তু মাঝেমধ্যে মনে হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রশংসাগুলো বেশ ফাঁপা। বিশেষত যার যেচে আলাপ করে, গায়ে পড়ে লেখার প্রশংসা করে, তাঁদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ লেখা না পড়ে কথা বলে। আর লেখক হিসেবে সেই দেখনাই ব্যাপারগুলো বড় গায়ে লাগে।
- বলিস কী...।
- বোঝা যায় রে। একটু খুঁচিয়ে দিলেই ফাঁপা প্রশংসা, আর লোকদেখানো পিঠচাপড়ানি ধরে ফেলা যায়। লেখক হিসেবে, আমি অন্তত পড়তে পারি।
- বেশ তিতিবিরক্ত মনে হচ্ছে তোকে মনোজ।
- বিরক্ত হওয়াটা তো অস্বাভাবিক নয়৷ লোকে এক'দু'পাতা পড়ে গোটা নভেলের রিভিউ লিখে ফেলছে। সাহিত্যসভায় ভারিক্কি চাল ফলিয়ে ভুলভাল রেফারেন্স দিয়ে বাহবা জানাচ্ছে। অনেকে অল্পবিস্তর হয়ত পড়েওছে, অথচ সে'টা নিয়ে বাতেলা ঝাড়বে চোদ্দগুণ৷ বুক বাজিয়ে তাঁরা এই উপন্যাসের নায়কের সঙ্গে অন্য উপন্যাসের ভিলেনকে গুলিয়ে ফেলে চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলবে। তুই বল দেবু, গায়ে পড়ে বেফালতু প্রশংসা না করে কথা বলা যায়না নাকি? আমার লেখা পড়তেই হবে এমন দিব্যি কে দিয়েছে?
- তোর মাথাটা দেখছি আগুন হয়ে আছে।
- এই ধর, আজ সকালে অনিল দত্তর সঙ্গে দেখা হল..।
- দিবানিশি পত্রিকার সেই সম্পাদক?
- হ্যাঁ, ওই৷ সে কী বলে জানিস? আমার মরুভূমি উপন্যাসে আমি পরিবেশের রুক্ষতাকে যে' মুন্সিয়ানার সঙ্গে ব্যাবহার করেছি; নায়কের মনের অসহায় অবস্থাকে তুলে ধরতে তার নাকি কোনও জবাব নেই৷ ভাবা যায়! আরে বাবা, মরুভূমির প্লটটা যে আমি চেরাপুঞ্জির ব্যাকগ্রাউন্ডে লিখেছি আর সে'টায় মূল চরিত্র যে সুচরিতা নামের একজন নারী, সে'টা ভদ্রলোক জানেন না কারণ বইটা তিনি পড়েনইনি৷ গাজোয়ারি দু'টো কথা না বললে সম্পাদকে পেটের ভাত হজম হয় কী করে।
- হা হা হা হা হা হা...।
- তুই হাসছিস দেবু?
- হাসব না? মরুভূমির ব্যাপারে তোকে জ্ঞান দিলে অথচ সে ব্যাটা সুচরিতার কথা জানে না!
- তোর এ'টা শুনে গা জ্বলছে না?
- তুই বেশি পাত্তা দিচ্ছিস মনোজ৷ বেনোজল থাকবেই৷ ফোকাস অন দ্য পসিটিভস।
- অসুবিধে হচ্ছে এরাই মেজরিটি৷ সে'দিন কফিহাউসে একজন মহিলা যেচে আলাপ করতে এলে। নিজের পরিচয় দিলে, পেল্লায় কলেজের প্রফেসর৷ স্মার্ট, কথাবার্তায় ধার আছে। সবে যখন মনে হচ্ছে এর সঙ্গে আলাপ হয়ে ভালোই হল; অমনি সে বললে আমার লেখা অনিমিখ সান্যাল চরিত্রটা নাকি তাকে সাংঘাতিক ইনফ্লুয়েন্স করেছে৷ ও'রকম রোম্যান্টিক ক্যারেক্টার নাকি শেষ সে পড়েছে বিভূতিভূষণের লেখায়৷
- অনিমিখ?
- অনিমিখের কথা তুই শুনিসনি, পড়িসনি৷ স্বাভাবিক। কারণ ও'নামে কোনও চরিত্র নিয়ে কোনোদিন কিছু আমি লিখিনি৷ ভদ্রমহিলা শুভময় লাহার একটা উপন্যাসের সঙ্গে আমার লেখা গুলিয়ে ফেলেছেন৷ ওই ভদ্রলোকের লেখা তো বোধ হয় তুই পড়িসটড়িস না, তাই না?
- না, ভীষণ প্রিটেনশাস৷ সহ্য হয় না৷ তবে ভদ্রমহিলাকে বিশেষ দোষ দিতে মন সরছে না রে মনোজ৷ না হয় তোর মধ্যে সুপুরুষ লেখকের সঙ্গে আলাপ জমাতে গিয়ে নার্ভাস হয়ে গল্প-চরিত্র গুলিয়ে ফেলেছে৷ কিন্তু ও'সব রাগ পুষে রাখাটা কিন্তু তোর বাড়াবাড়ি৷
- না রে দেবু। গোটা ব্যাপারটা তুই যতই লঘু করে দেখতে চাস, ইস্যুটা সিরিয়াস৷ লেখক কি শুধুই নামধাম টাকাপয়সা চায় রে? জেনুইন অ্যাপ্রিশিয়েশন আর ক্রিটিসিজম কি পৃথিবী থেকে উবে গেছে?
- আমার মত কয়েকজন এখনও পড়ে আছি ভাই। সে'টার কি কোনও মূল্যই নেই? নাকি অচেনা মানুষের প্রশংসা না পেলে লেখকদের চলে না।
- সরি দেবু, সত্যিই। তোর মত পাঠক-বন্ধু এখনও আছে বলে আমার মত ওঁচা লেখকও লিখে তৃপ্তি পায়।
- ওই, শ্যামলালের সিরিয়াল শেষ হল। দাঁড়া, ওকে বরং আজ কফি বানাতে বলি। সঙ্গে পকোড়া।
- হোক। হোক।
***
নভেলের পাণ্ডুলিপি পড়ে, শ্যামলালের বানানো মুর্গির ঝোল আর এঁচোড়ের তরকারি দিয়ে ডিনার সেরে, দেবুকে টাটা বলে যখন মনোজবাবু ট্যাক্সিতে বসলেন তখন রাত সোয়া এগারোটা। শ্যামলালের রান্নায় সত্যিই জাদু আছে, ও ভাতেভাত রাঁধলেও সে'টা অমৃত মনে হয়। মনোজবাবুর মনের মধ্যে একটা বিশ্রী অন্ধকার জমাট বেঁধেছিল বটে, চমৎকার ডিনারের গুণে সে অন্ধকার খানিকটা কেটেছে। তবে মনের এই খচখচ সহজে যাওয়ার নয়। যে দেবুকে লেখা পড়িয়ে তাঁর এত আনন্দ, সে যে খুব একটা মন দিয়ে তাঁর গল্প-উপন্যাস পড়ে না বা শোনে না; এ'টা ভাবতেই কেমন বুকের ভিতরটা ঠাণ্ডা হয়ে আসে।
দেবু সত্যিই জানে না যে তাঁর মরুভূমি উপন্যাসের মূল চরিত্র সুজয় দত্ত নামের একজন রিটায়ার্ড ইতিহাসের প্রফেসর আর সে উপন্যাসের পটভূমি হল রাজস্থান। আর অনিমিখ সান্যাল যে মনোজবাবুরই কলমে তৈরি হওয়া লেখক, এবং তাঁর "ভোরবেলা" নভেলের নায়ক; সে'টাও দেবু হয় জানেনই না বা বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছেন। ভাবলে অবাক লাগে যে এ'দুটো উপন্যাস নিয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে গেছেন মনোজবাবু। আর প্রত্যেকবারই মনে হয়েছে যে দেবু মুগ্ধ হয়ে সে'সব কথা শুনেছে। আজ ব্যাপারটা স্পষ্ট হল অবশ্য, দেবুর মাথা নাড়া ও স্মিত হাসির মধ্যে আস্কারা আছে, ধৈর্য নেই। তবে সে দুঃখ পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। শ্যামলালের রান্নার টানটা এড়িয়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। অমন যাদু-রান্নার তুলনায় তাঁর লেখা ছেঁদো উপন্যাস-টুপন্যাস তো নেহাতই এলেবেলে ব্যাপার।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

ব্লগ-বাজ

আর চিন্তা নেই । বাঙালিকে আর রোখা যাবে না । আর সামান্য (সম্ভবত কিঞ্চিত গোলমেলে ) কবিতা ছাপাবার জন্যে সম্পাদক কে তোল্লাই দিতে হবে না । আর প্রেমে লটরপটর হয়ে ডায়েরি লিখে প্রাণপাত করতে হবে না। পলিটিক্স কে পাবলিক-জন্ডিস বলে গাল দেওয়ার জন্য আর “প্রিয় সম্পাদক” বলে আনন্দবাজারের ঠ্যাং ধরতে হবে না। কেন ?  হোয়াই? বাঙালি ব্লগিং শিখে গ্যাছে যে। ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে শাণিত তলোয়ারের মত “ পোস্ট”-সমূহ জনতার ইন্টেলেক্ট এসপার-ওসপার করে দেবে ; হাতে-গরম গায়ে-কাঁটা। বাঙালি মননের নব্য জিস্পট ; ব্লগ-স্পট । কে বলে যে বাঙালি ব্রিগেডে বুক্তুনি দিয়ে আর ফুটবল মাঠে খেউড় করে খতম হয়ে গ্যাছে ? কে বলে যে বাঙালির ঘিলু কফি হাউসে ভাত ঘুমে মগ্ন ? বাঙালিকে একবার ব্লগখোর হতে দিন , সমস্ত অভিযোগ ভ্যানিশ হয়ে যাবে । পোপ থেকে পরশুরাম ; ডেঙ্গু থেকে মশাগ্রাম ; বং-ব্লগের দাপট রইবে সর্বত্র । বাঙালির সমস্ত আশা-ভরসা-জিজ্ঞাসা এইবারে ব্লগ মারফত্‍ পৌছে যাবে ট্যাংরা ট্যু টেক্সাস । তোপসে মাছের স্প্যানিশ ঝোলের রেসিপি কী ? বাঙাল-ঘটি মিল মহব্বত-হয়ে গেলে কি বাঙ্গালিয়ানা চটকে যাবে ? নেতাজী কি এখ

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু