Skip to main content

শোক

- মামাবাবু, বসুন না। এই'এখানে। আপনি বসুন, আমি চা-বিস্কুট দিতে বলে দিচ্ছি।
- আরে, বেঞ্চি সাফ করতে হবে না।
- আরে, ধুলো দেখেছেন? নদীর ওপারেই মিল, ওই দেখুন। ওই যে চিমনি। এই পুঁছলাম তো, মিনিট দশ পরেই দেখবেন ফের কালো ধুলোর আস্তরণ পড়ে গেছে। আপনার প্যান্টট্যান্ট এক্কেবারে যেত আর কী...। নিন, বসুন। ও ঘোঁটনদা, মামাবাবুর জন্য এক কাপ চা, দু'টো বিস্কুট। ইয়ে মামাবাবু, চায়ে চিনি থাকবে?
- দুধ-চিনি দু'টোই বাদ।
- ঘোঁটনদা, কালো চা দিও। আর বিস্কুটটাও তা'লে নোনতা। জলদি জলদি।
- তোমার নাম তো বাপন, তাই না?
- হ্যাঁ। ভালো নাম অভিজিৎ সাহা। আপনি আমায় বাপনই বলবেন।
- ও'দিকের ব্যাপারটা কী বুঝছ, কিছু একটা সমস্যা হয়েছে শুনলাম...।
- ও নিয়ে আপনি ভাববেন না।
- তবু, নীলুর বডিটাকে নিয়ে কোনও...।
- তেমন কিছু নয়। ওর আধার কার্ড নেই। অন্যান্য কোনও আইডেন্টিটি কার্ডও খুঁজে পাইনি। আমি নিজে ওর বাসায় গিয়ে জিনিসপত্র উলটেপালটে দেখেছি। তাই কর্পোরেশনের লোক বলছে বডি চুল্লিতে তোলা যাবে না।
- এ তো সমস্যাই বটে। আচ্ছা, কিছু পয়সাকড়ি দিয়ে যদি...মানে আমিই দেব...।
- ও মা, না না। তার দরকার হবে না আশা করি। পল্টনের মেজপিসের থানায় চেনাজানা আছে। পল্টন আর কিছু ছেলেপিলে মিলে তাই থানায় গেছে। ও'খান থেকে লিখিয়ে আনলেই হয়ে যাবে। এই আর আধ ঘণ্টার মধ্যে চলে আসবে। ও নিয়ে আপনি ভাববেন না।
- নীলুর খবরটা...।
- ওর শরীরটা একেবারেই ভেঙে পড়েছিল মামাবাবু। গতমাসেও একবার হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। ওই আমরা সকলে মিলেই...। এ'বারে আর সে সুযোগ দিল না।
- আসলে এত ইনডিসিপ্লিন, নেশা-ভাঙ; এত অত্যাচার আর কদ্দিন সইবে।
- হ্যাঁ, ছেলেটা বড্ড বেশিই...।
- তোমরা তো ওর বন্ধু..পারতে না ওকে আর একটু সামলে রাখতে?
- এই যে মামা, চা। আসুন।
- তুমি খাবে না?
- আমি এই খানিক আগেই খেলাম। আপনি খান না মামা। আপনি খান।
- ছেলেটা এইভাবে...।
- আপনি ও নিয়ে ভেবে কষ্ট পাবেন, স্বাভাবিক। কিন্তু যা ভুগছিল, আমি বন্ধু হয়েই বলছি, মুক্তি পেল।
- কোনও খবরাখবরও তো পেতাম না...। একটা মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছিলাম এক কালে, সে'টাও ফেলে দিয়েছিল। নাকি বেচে খেয়েছিল কে জানে!
- আপনি ওকে মাসে মাসে টাকা পাঠাতেন, তাই না মামাবাবু?
- সে বখে যেতে পারে। সে গোল্লায় যেতে পারে। মদো-মাতাল হয়ে নিজেকে নষ্ট করতে পারে। কিন্তু আমি তাকে ভুলে থাকি কী করে। আমার দিদির রক্ত ওর শরীরে বইছে। তবে কী জানো, বাপন! আমি অন্যায় করেছি ওকে নিয়মিত মাসহারা পাঠিয়ে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, অন্যায় করেছি। সে'সব টাকা দিয়ে চোলাই খেত নিশ্চয়ই। কে জানে, আমিই হয়ত খুন করলাম ওকে।
- অমন ভাবে ভাববেন না মামাবাবু। অমন ভাববেন না। আপনি কর্তব্য করেছেন, তা নিয়ে আর ভাবার কী আছে...এই মরেছে। বৃষ্টি না আসে।
- আসুক। হাড় জুড়োক। বেঁচে থাকতে তো সে কম হাড় জ্বালায়নি। দিদিকে কম জ্বালাযন্ত্রণা দেয়নি। লোফারগিরি, মাস্তানি, মদ, ড্রাগস; কী বাদ রেখেছিল সে?
- সবই তো জানেন মামাবাবু। আজকের দিনটা বরং থাক...।
- কেন থাকবে? আমার অমন ফুলের মত দিদি। কী কষ্ট পেয়েই না মরলে। কতবার বলেছি, দিদি, তুই আমার বম্বের ফ্ল্যাটে গিয়ে থাকবি চ'। কিন্তু ছেলেকে ছেড়ে যেতে চাইল না। নিজের মাকে খেলে, এখন নিজেও...।
- মামাবাবু।
- সরি। সরি বাপন। আসলে, আমি একটু...।
- বুঝি মামাবাবু। বুঝি। আপনার সঙ্গে নীলুর রক্তের সম্পর্ক। আপনি ওকে চিনবেন না তো কে চিনবে।
- চিনি। হাড়ে হাড়ে চিনি। আর চিনি বলেই এত যন্ত্রণা, রাগ, দুঃখ, অভিমান। ওইটুকুন ছেলে এ বয়সে চলে গেল। দিদির শেষ চিহ্নটুকু...। এই তোমায় বলে রাখলাম বাপন, আমার আজ যত দুঃখ-কান্না; সবই দিদির কথা ভেবে। আদারওয়াইজ, নীলুর ওপর কোনও সিমপ্যাথি আমার অন্তত নেই। কারণ আমি ওকে আর ওর বদভ্যাসগুলোকে দিব্যি চিনি।
- মামাবাবু, চা'টা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে যে।
- ও হ্যাঁ।
- চা'টা খেয়ে নিন। তারপর আপনাকে না হয় একবার দেখা করিয়ে আনি।
- দেখা? সে তো আর নেই। শুধু তো ওই বডি...।
- মামাবাবু, নীলু ছেলেটা সুবিধের ছিল না, এ কথা সত্যি। পাড়ার সবাই তা জানে। আমিও জানি। আর আপনি কাছের মানুষ, আপনি তো চিনবেনই। নিজের লিভার পচিয়ে দেওয়া মাতাল। বখাটে। তবে...আপনার টাকায় কেনা মদ ওর পেট পচিয়ে দেয়নি। সে' দুঃখ বা গ্লানি আপনাকে বয়ে বেড়াতে হবে না।
- তুমি কী'ভাবে জানো সে কথা?
- আপনি জানেন মামাবাবু, গত বছর পাঁচেক দিনের বেশিরভাগ সময় সে এই শ্মশানের কালীমন্দিরেই পড়ে থাকত।
- ভক্তিভাব জেগেছিল নাকি?
- তা ঠিক নয়। মন্দিরের ফাইফরমাশ খাটত। বিনিপয়সায় খাওয়ারদাওয়ার পেত। প্রসাদের কল্যাণে নেশা-ভাঙের সামগ্রীরও অভাব ঘটত না। আমরা, ওঁর বখে যাওয়া ইয়ারদোস্তরা কতবার বলেছি, আপনার পাঠানো টাকায় একদিন আমাদের ভালোমন্দ খাওয়াতে। সে কী বলত জানেন? আমার মামার আয় ছাত্র-পড়িয়ে, সে বড় পুণ্যের টাকা। সে টাকা নাকি সে জলে দিতে পারবে না।
- আমার পাঠানো টাকা সে খরচ করত না বলছ?
- সমস্তটাই খরচ করত। মন্দিরের পিছনে কয়েক বিঘে জমি রুখাশুখা হয়ে পড়েছিল কত বছর। সে জমি কুপিয়ে, লালন করে নরম করেছে আমাদের নীলু। একা হাতে, ধীরেসুস্থে, অনেক বছর খেটে। আপনার টাকা দিয়ে সে মাসের পর মাস গাছ কিনেছে, সার কিনেছে, আর কিনেছে বাগান করার কত সামগ্রী। মন্দিরের পিছনটা এখন সবুজে-সবুজ; কৃষ্ণচূড়া, নিম, বাঁদরলাঠি। পাশাপাশি আম, পেঁপে, পেয়ারা, জামরুলও আছে। আমরা সবাই সে বাগানকে বলি মামাবাবুর বাগান। কত পাখির আখড়া এখন সে'টা। দেখতে যাবেন মামাবাবু? চলুন না।
- যাব? চলো, যাই। দেখি ব্যাটা কী করে রেখেছে। কী জানো বাপন, ছেলেটাকে চিরকাল নিখুঁত ভাবে চিনেই গেলাম আমরা সবাই; আত্মীয়স্বজনরা যেমন সহজেই দূর থেকে চিনে রাখে আর কী। কিন্তু রাস্কেলটার জীবনে উঁকি মারার কৌতূহল কারুর কোনোদিন হয়নি। অসুবিধেটা হল...True love is not about decoding a person. It is all about staying curious। যাকগে। চলো, মামাবাবুর বাগান দেখে আসি।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

ব্লগ-বাজ

আর চিন্তা নেই । বাঙালিকে আর রোখা যাবে না । আর সামান্য (সম্ভবত কিঞ্চিত গোলমেলে ) কবিতা ছাপাবার জন্যে সম্পাদক কে তোল্লাই দিতে হবে না । আর প্রেমে লটরপটর হয়ে ডায়েরি লিখে প্রাণপাত করতে হবে না। পলিটিক্স কে পাবলিক-জন্ডিস বলে গাল দেওয়ার জন্য আর “প্রিয় সম্পাদক” বলে আনন্দবাজারের ঠ্যাং ধরতে হবে না। কেন ?  হোয়াই? বাঙালি ব্লগিং শিখে গ্যাছে যে। ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে শাণিত তলোয়ারের মত “ পোস্ট”-সমূহ জনতার ইন্টেলেক্ট এসপার-ওসপার করে দেবে ; হাতে-গরম গায়ে-কাঁটা। বাঙালি মননের নব্য জিস্পট ; ব্লগ-স্পট । কে বলে যে বাঙালি ব্রিগেডে বুক্তুনি দিয়ে আর ফুটবল মাঠে খেউড় করে খতম হয়ে গ্যাছে ? কে বলে যে বাঙালির ঘিলু কফি হাউসে ভাত ঘুমে মগ্ন ? বাঙালিকে একবার ব্লগখোর হতে দিন , সমস্ত অভিযোগ ভ্যানিশ হয়ে যাবে । পোপ থেকে পরশুরাম ; ডেঙ্গু থেকে মশাগ্রাম ; বং-ব্লগের দাপট রইবে সর্বত্র । বাঙালির সমস্ত আশা-ভরসা-জিজ্ঞাসা এইবারে ব্লগ মারফত্‍ পৌছে যাবে ট্যাংরা ট্যু টেক্সাস । তোপসে মাছের স্প্যানিশ ঝোলের রেসিপি কী ? বাঙাল-ঘটি মিল মহব্বত-হয়ে গেলে কি বাঙ্গালিয়ানা চটকে যাবে ? নেতাজী কি এখ

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু