Skip to main content

ছোটবেলার স্মৃতি আর কয়েকটা বইয়ের টুকরো



বই পড়ার মধ্যে আর ডিসিপ্লিন আনা হলো না। এ বইয়ের দু'পাতা, ও বইয়ের চার পাতা, তার পাশাপাশি আর এক বইয়ের দু'প্যারাগ্রাফ৷ এইভাবেই খামচাখামচি করে ঢিকিরঢিকির করে এগোনো। কোনও বই হপ্তাখানেকে শেষ হয়, কোনও বই কয়েক মাস জুড়ে এগিয়ে চলে৷

অনেকগুলো বই পাশাপাশি বেহিসেবি স্টাইলে পড়াটা নির্ঘাৎ একটা "ব্যাড হ্যাবিট"৷ তবে সেই বদভ্যাসের মধ্যে একটা মজাও আছে; অনেক সময় সম্পূর্ণ আলাদা কয়েকটা বইয়ের মধ্যে খুব মনোগ্রাহী কিছু যোগসূত্র বেরিয়ে পড়ে৷ আর মনের লাটাইয়ে সেই যোগাযোগের সুতো জড়িয়ে চলায় যে কী প্রবল আরাম আর আনন্দ, আহা! 

এই যেমন অরুণাভ সিনহা কয়েকটা সহজ প্যারাগ্রাফের মধ্যে দিয়ে কী সুন্দরভাবে লিখেছেন ছেলেবেলায় মায়ের মুখ থেকে গল্প শোনার কথা৷ বলেছেন কী ভাবে মায়ের পড়া গল্পের রেশ ধরেই বাংলা ছোটগল্পের চমৎকার দুনিয়াটাকে আত্মস্থ করেছেন তিনি৷ সেই ছোট্ট পরিচ্ছেদে, উপন্যাসের আর ছোটগল্পের মধ্যে যে মৌলিক তফাৎ, তা নিয়েও চমৎকার কয়েকটা কথা বলেছেন। কিন্তু সেই সব অ্যানালিসিসের বাইরে গিয়ে যে'টা উজ্জ্বল সে'টা হল তার ছেলেবেলার স্মৃতির ঝলক।

আবার এর পাশাপাশি পড়ছি নাসিরুদ্দিন শাহর ছেলেবেলায় স্মৃতিচারণ৷ আত্মকথা বেশ কিছু পড়েছি৷ কিন্তু সততা ও গাম্ভীর্যের সঙ্গে রূপকথা বলার স্টাইল যে এমন নির্ভেজাল ভাবে মিশতে পারে, সে'টা আগে টের পাইনি। ভদ্রলোক আরও লেখেন না কেন? সিনেমা এবং অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হওয়ার নিয়ে লিখতে গিয়ে যেন কুয়াশাঢাকা কবিতার মধ্যে সেঁধিয়ে যাচ্ছেন ভদ্রলোক; ছেলেবেলাটা যেন কবিতা৷ ব্যথা, যন্ত্রণা, ট্রমা, হতাশা সত্ত্বেও সেই কবিতা সুমিষ্ট।

আর এর সঙ্গে পড়ছি (অডিওবুক, অতএব শুনছি) স্টিফেন ফ্রাই সাহেবের আত্মজীবনী৷ এই আর এক ভদ্রলোক। ঠোঁটকাটা অথচ কাটখোট্টা নন, সোজাসাপটা কথার মানুষ অথচ রূঢ় নন৷ তাঁর ভাষা যতটা সহজ, ততটাই গভীর; যতটা সরল, ততটাই স্মার্ট হিউমরে ঋদ্ধ। সেই প্রাণোচ্ছল ভাষা নিয়ে ফ্রাইবাবু নিজের ছেলেবেলায় ফিরে গেছেন৷ অঙ্কের হিসেবে সে শৈশবকে নিশ্চিন্তে অন্ধকারাচ্ছন্ন বলা যায়; ছোট্ট স্টিফেনের মধ্যে অকারণ মিথ্যে বলার অভ্যাস তৈরি হচ্ছে, সে চুরি করছে, লোক ঠকাচ্ছে, নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে৷ সে'সব কথা সোজাসুজি সাজিয়েও দিচ্ছেন ফ্রাইবাবু, ইনিয়েবিনিয়ে নিজেকে অসহায় প্রতিপন্ন করতে চাইছেন না৷ অথচ কী আশ্চর্য; সেই স্বীকারোক্তি সত্ত্বেও তাঁর ছোটবেলার গল্পগুলো তিতকুটে হয়ে উঠছে না৷ বরং চমৎকার নভেলের মত তরতরিয়ে এগিয়ে চলেছে৷ 

ছোটবেলার স্মৃতির মধ্যে যে কী মায়া৷ সে স্মৃতিতে অঙ্কস্যারের মুখচোপার স্মৃতি ফিকে হয়ে যায় আর আলোয় আলোময় হয়ে ওঠে অঙ্কখাতার পাতায় নোট করা ক্রিকেট স্কোর। কমিক্স বইয়ের ছিঁড়ে যাওয়া মলাট মনে পড়ে, মেটে রঙের লক্ষ্মীর ঘটের গায়ে স্কেচপেনে আঁকা ডোনাল্ড ডাক মনে পড়ে। আর সে অদরকারী সমস্ত স্মৃতির টুকরোর মধ্যে মারাত্মক সব "লাইফ লেসন" মিশেছ,  মাঝবয়সে এসে এ'সব থিওরি কপচাতে কপচাতে নিজেকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে; "নাহ্, আমি মানুষটা নেহাৎ ফেলনা নই"৷ ইচ্ছে করে, সে বয়সের আমিটার মাথায় যদি হাত বুলিয়ে বলি, "ভালোভাবে থেকো খোকা, কেমন"? আর সেই ইচ্ছেটাই আমার মত এলেবেলে পাঠককেও সহজেই জুড়ে দেয় অরুণাভ, নাসির বা স্টিফেনের সঙ্গে। 

(ছবি: দ্য সানি-সাইড-আপ, শিল্পী: বালিশেন্দ্র)

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

ব্লগ-বাজ

আর চিন্তা নেই । বাঙালিকে আর রোখা যাবে না । আর সামান্য (সম্ভবত কিঞ্চিত গোলমেলে ) কবিতা ছাপাবার জন্যে সম্পাদক কে তোল্লাই দিতে হবে না । আর প্রেমে লটরপটর হয়ে ডায়েরি লিখে প্রাণপাত করতে হবে না। পলিটিক্স কে পাবলিক-জন্ডিস বলে গাল দেওয়ার জন্য আর “প্রিয় সম্পাদক” বলে আনন্দবাজারের ঠ্যাং ধরতে হবে না। কেন ?  হোয়াই? বাঙালি ব্লগিং শিখে গ্যাছে যে। ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে শাণিত তলোয়ারের মত “ পোস্ট”-সমূহ জনতার ইন্টেলেক্ট এসপার-ওসপার করে দেবে ; হাতে-গরম গায়ে-কাঁটা। বাঙালি মননের নব্য জিস্পট ; ব্লগ-স্পট । কে বলে যে বাঙালি ব্রিগেডে বুক্তুনি দিয়ে আর ফুটবল মাঠে খেউড় করে খতম হয়ে গ্যাছে ? কে বলে যে বাঙালির ঘিলু কফি হাউসে ভাত ঘুমে মগ্ন ? বাঙালিকে একবার ব্লগখোর হতে দিন , সমস্ত অভিযোগ ভ্যানিশ হয়ে যাবে । পোপ থেকে পরশুরাম ; ডেঙ্গু থেকে মশাগ্রাম ; বং-ব্লগের দাপট রইবে সর্বত্র । বাঙালির সমস্ত আশা-ভরসা-জিজ্ঞাসা এইবারে ব্লগ মারফত্‍ পৌছে যাবে ট্যাংরা ট্যু টেক্সাস । তোপসে মাছের স্প্যানিশ ঝোলের রেসিপি কী ? বাঙাল-ঘটি মিল মহব্বত-হয়ে গেলে কি বাঙ্গালিয়ানা চটকে যাবে ? নেতাজী কি এখ

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু