Sunday, February 12, 2023

তাপসবাবুর জর্দাপান



রাতের খাওয়া সেরে হাঁটতে বেরোনোটা তাপসবাবুর পুরনো অভ্যাস৷ সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে, গলি ধরে আধমাইল এগোলেই চৌরাস্তার মোড়৷ সে'খানে নির্মলের পানের দোকান। নির্মলকে একটা ইশারা ভাসিয়ে দিয়ে এগিয়ে যাবেন রেলের মাঠের দিকে৷ সে ইশারাটা একশো-কুড়ি জর্দা পান বানানোর সিগন্যাল৷
**
ঘাড় ঘুরিয়ে দোকানের পিছনের দেওয়ালে রাখা অজন্তা ঘড়িটার দিকে তাকালো নির্মল; সোয়া এগারোটা৷ তাপসদার আসার সময় হচ্ছে৷ সামনে দাঁড়ানো খদ্দেরকে ফ্লেক দিয়ে পানের পাতায় চুন মাখাতে শুরু করলে সে৷
**
রেলের মাঠটা এ সময় ফাঁকাই থাকে, চারপাশটা নিশ্চুপ। শুধু মাঝেমধ্যে রেলকলোনির ওয়াচম্যান সমরের হুইসল শোনা যায়৷ নিস্তব্ধতা চিরে ফেলা সেই কর্কশ হুইসেলের শব্দটা তাপসবাবুর কানে সয়ে গেছে। মাঠটা দু'বার চক্কর দিয়ে ফের বাড়িমুখো হন তাপসবাবু৷
**
একশো-কুড়ি জর্দা পানটা সেজে শালপাতায় মুড়ে দোকানের টিনের ছাতে রেখে দিল নির্মল৷ তারপর দোকানের ঝাঁপ নামিয়ে তালা দিলে৷ রেলকলোনি থেকে সমরদার হুইসলের শব্দ ভেসে এলো৷ এ'বার যেতে হবে স্টেশনের দিকে, লাস্ট ট্রেনে বাড়ি ফেরা৷
**
কত বছর হয়ে গেল, নেহাৎ বড়সড় কোনও গোলমাল না হলে তাপসবাবুর এই হাঁটাহাঁটির নিয়মের এ'দিক-ও'দিক নেই৷ বৃষ্টিটৃষ্টি নামলে ছাতা মাথায় বেরিয়ে পড়েন, কিন্তু ডিসিপ্লিনে ফাঁকিটা বরদাস্ত করতে পারেন না তিনি। নির্মলের সাজা জর্দাপানটাও সেই ডিসিপ্লিনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
**
শিফট হ্যান্ডওভার করে ছুট্টে প্ল্যাটফর্মে এসে হাজির হয় সমর৷ নির্মলের সঙ্গে একই ট্রেনে তাঁর বাড়ি ফেরা৷ দু'জনেই ইঞ্জিনের দিক থেকে তিন নম্বর কামরাটায় ওঠে৷ কামরা বিলকুল ফাঁকা থাকে, কাজেই নির্দ্বিধায় বিড়ি ধরায় নির্মল, সমর কাউন্টারে ধরে।
- নির্মলদা, এই ব্যাপারটা বড্ড বেশিদিন টানা হচ্ছে না?
- কোন ব্যাপারটা।
- ওই যে, তাপস দত্তর জন্য তোমার রোজ জর্দাপান বানানো।
- ডিসিপ্লিনে নড়চড় ব্যাপারটা তাপসদা সইতে পারবে ভেবেছিস? কী রোয়াবটাই না ছিল ভদ্রলোকের।
- সইতে পারা না পারার প্রশ্ন আসছে কেন..।
- না হয় গতবছর খামোখা ট্রেনে কাটাই পড়ল। তা বলে কী সব শেষ ভেবেছিস? জাস্ট মরে গেছে বলে ওই ডিসিপ্লিন-পাগলা মানুষ হাঁটার রুটিন সহজে ছেড়ে দেবে ভেবেছিস?
- তুমি নিশ্চিত? ভদ্রলোক এখনও রাতের হাঁটা ছাড়েননি?
- আলবাত৷ নয়ত আমার দোকানের ছাতে রাখা পান রোজ রাত্রে গায়েব হয়ে যায় কেন?
- গোলমেলে ব্যাপারই বটে। কী জানো, শিফটের শেষ কয়েকটা হুইসল দেওয়ার সময় গায়ে কাঁটা দেয় বটে৷
***
নির্মল আর একটা বিড়ি ধরিয়ে জানালার শিকে মাথা ঠেকিয়ে কিশোরকুমারের গান ধরে৷ তাঁর সরল মুখের দিকে তাকিয়ে একটা চিনচিনে অপরাধবোধ টের পায় সমর৷ সামান্য একটা একশো-কুড়ি জর্দাপান রোজ বিনেপয়সায় খাওয়ার লোভ এমন পেয়ে বসেছে৷
শুধু একটা খটকা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেনা রেলকলোনির ওয়াচম্যান সমর সাহা৷ নির্মল কেন বলে যে রোজ রাতে তার দোকানের ছাতে রাখা জর্দাপান গায়েব হয়ে যায়? সমরের ছুটি বা কামাইয়ের দিনগুলোতে সে পান গায়েব হবে কেন?
গায়ের কাঁপুনিটা পাত্তা না দিয়ে নির্মলের থেকে বিড়ির কাউন্টার চায় সমর।

No comments: