Skip to main content

তাপসবাবুর জর্দাপান



রাতের খাওয়া সেরে হাঁটতে বেরোনোটা তাপসবাবুর পুরনো অভ্যাস৷ সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে, গলি ধরে আধমাইল এগোলেই চৌরাস্তার মোড়৷ সে'খানে নির্মলের পানের দোকান। নির্মলকে একটা ইশারা ভাসিয়ে দিয়ে এগিয়ে যাবেন রেলের মাঠের দিকে৷ সে ইশারাটা একশো-কুড়ি জর্দা পান বানানোর সিগন্যাল৷
**
ঘাড় ঘুরিয়ে দোকানের পিছনের দেওয়ালে রাখা অজন্তা ঘড়িটার দিকে তাকালো নির্মল; সোয়া এগারোটা৷ তাপসদার আসার সময় হচ্ছে৷ সামনে দাঁড়ানো খদ্দেরকে ফ্লেক দিয়ে পানের পাতায় চুন মাখাতে শুরু করলে সে৷
**
রেলের মাঠটা এ সময় ফাঁকাই থাকে, চারপাশটা নিশ্চুপ। শুধু মাঝেমধ্যে রেলকলোনির ওয়াচম্যান সমরের হুইসল শোনা যায়৷ নিস্তব্ধতা চিরে ফেলা সেই কর্কশ হুইসেলের শব্দটা তাপসবাবুর কানে সয়ে গেছে। মাঠটা দু'বার চক্কর দিয়ে ফের বাড়িমুখো হন তাপসবাবু৷
**
একশো-কুড়ি জর্দা পানটা সেজে শালপাতায় মুড়ে দোকানের টিনের ছাতে রেখে দিল নির্মল৷ তারপর দোকানের ঝাঁপ নামিয়ে তালা দিলে৷ রেলকলোনি থেকে সমরদার হুইসলের শব্দ ভেসে এলো৷ এ'বার যেতে হবে স্টেশনের দিকে, লাস্ট ট্রেনে বাড়ি ফেরা৷
**
কত বছর হয়ে গেল, নেহাৎ বড়সড় কোনও গোলমাল না হলে তাপসবাবুর এই হাঁটাহাঁটির নিয়মের এ'দিক-ও'দিক নেই৷ বৃষ্টিটৃষ্টি নামলে ছাতা মাথায় বেরিয়ে পড়েন, কিন্তু ডিসিপ্লিনে ফাঁকিটা বরদাস্ত করতে পারেন না তিনি। নির্মলের সাজা জর্দাপানটাও সেই ডিসিপ্লিনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
**
শিফট হ্যান্ডওভার করে ছুট্টে প্ল্যাটফর্মে এসে হাজির হয় সমর৷ নির্মলের সঙ্গে একই ট্রেনে তাঁর বাড়ি ফেরা৷ দু'জনেই ইঞ্জিনের দিক থেকে তিন নম্বর কামরাটায় ওঠে৷ কামরা বিলকুল ফাঁকা থাকে, কাজেই নির্দ্বিধায় বিড়ি ধরায় নির্মল, সমর কাউন্টারে ধরে।
- নির্মলদা, এই ব্যাপারটা বড্ড বেশিদিন টানা হচ্ছে না?
- কোন ব্যাপারটা।
- ওই যে, তাপস দত্তর জন্য তোমার রোজ জর্দাপান বানানো।
- ডিসিপ্লিনে নড়চড় ব্যাপারটা তাপসদা সইতে পারবে ভেবেছিস? কী রোয়াবটাই না ছিল ভদ্রলোকের।
- সইতে পারা না পারার প্রশ্ন আসছে কেন..।
- না হয় গতবছর খামোখা ট্রেনে কাটাই পড়ল। তা বলে কী সব শেষ ভেবেছিস? জাস্ট মরে গেছে বলে ওই ডিসিপ্লিন-পাগলা মানুষ হাঁটার রুটিন সহজে ছেড়ে দেবে ভেবেছিস?
- তুমি নিশ্চিত? ভদ্রলোক এখনও রাতের হাঁটা ছাড়েননি?
- আলবাত৷ নয়ত আমার দোকানের ছাতে রাখা পান রোজ রাত্রে গায়েব হয়ে যায় কেন?
- গোলমেলে ব্যাপারই বটে। কী জানো, শিফটের শেষ কয়েকটা হুইসল দেওয়ার সময় গায়ে কাঁটা দেয় বটে৷
***
নির্মল আর একটা বিড়ি ধরিয়ে জানালার শিকে মাথা ঠেকিয়ে কিশোরকুমারের গান ধরে৷ তাঁর সরল মুখের দিকে তাকিয়ে একটা চিনচিনে অপরাধবোধ টের পায় সমর৷ সামান্য একটা একশো-কুড়ি জর্দাপান রোজ বিনেপয়সায় খাওয়ার লোভ এমন পেয়ে বসেছে৷
শুধু একটা খটকা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেনা রেলকলোনির ওয়াচম্যান সমর সাহা৷ নির্মল কেন বলে যে রোজ রাতে তার দোকানের ছাতে রাখা জর্দাপান গায়েব হয়ে যায়? সমরের ছুটি বা কামাইয়ের দিনগুলোতে সে পান গায়েব হবে কেন?
গায়ের কাঁপুনিটা পাত্তা না দিয়ে নির্মলের থেকে বিড়ির কাউন্টার চায় সমর।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

ব্লগ-বাজ

আর চিন্তা নেই । বাঙালিকে আর রোখা যাবে না । আর সামান্য (সম্ভবত কিঞ্চিত গোলমেলে ) কবিতা ছাপাবার জন্যে সম্পাদক কে তোল্লাই দিতে হবে না । আর প্রেমে লটরপটর হয়ে ডায়েরি লিখে প্রাণপাত করতে হবে না। পলিটিক্স কে পাবলিক-জন্ডিস বলে গাল দেওয়ার জন্য আর “প্রিয় সম্পাদক” বলে আনন্দবাজারের ঠ্যাং ধরতে হবে না। কেন ?  হোয়াই? বাঙালি ব্লগিং শিখে গ্যাছে যে। ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে শাণিত তলোয়ারের মত “ পোস্ট”-সমূহ জনতার ইন্টেলেক্ট এসপার-ওসপার করে দেবে ; হাতে-গরম গায়ে-কাঁটা। বাঙালি মননের নব্য জিস্পট ; ব্লগ-স্পট । কে বলে যে বাঙালি ব্রিগেডে বুক্তুনি দিয়ে আর ফুটবল মাঠে খেউড় করে খতম হয়ে গ্যাছে ? কে বলে যে বাঙালির ঘিলু কফি হাউসে ভাত ঘুমে মগ্ন ? বাঙালিকে একবার ব্লগখোর হতে দিন , সমস্ত অভিযোগ ভ্যানিশ হয়ে যাবে । পোপ থেকে পরশুরাম ; ডেঙ্গু থেকে মশাগ্রাম ; বং-ব্লগের দাপট রইবে সর্বত্র । বাঙালির সমস্ত আশা-ভরসা-জিজ্ঞাসা এইবারে ব্লগ মারফত্‍ পৌছে যাবে ট্যাংরা ট্যু টেক্সাস । তোপসে মাছের স্প্যানিশ ঝোলের রেসিপি কী ? বাঙাল-ঘটি মিল মহব্বত-হয়ে গেলে কি বাঙ্গালিয়ানা চটকে যাবে ? নেতাজী কি এখ

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু