Skip to main content

ডায়োজিনিস আর আলেকজান্ডার



বড় শখ জানেন। বড় সাধ। 

একদিন, ডায়োজিনিসের মত ঘ্যাম নিয়ে আমি লেতকে পড়ে থাকব। চারদিকে বিস্তর হৈহল্লা, তুমুল ফুর্তি, আনন্দের বন্যা। এ ওকে জড়িয়ে ধরছে, ও একে হাই-ফাইভ অফার করছে, টেবিল কাঁপানো আড্ডা বসেছে। ও'দিকে ডায়োজিনিস-ঘ্যামে, আমি সোফায় হাত পা ছড়িয়ে আধশোয়া।  মুখে গুনগুন, তৃপ্তিতে বুজে আসা চোখ। যাবতীয় চিৎকার চ্যাঁচামেচি গলাগলি আবদার আমার গায়ে বাউন্স করে ফিরে যাচ্ছে। বন্ধুরা গপ্প ফাঁদতে আসবে, আমি বলব "রোককে ভায়া রোককে। মেডিটেশন মোডে রয়েছি"। পড়শিরা গসিপ করতে আসবে, আমি আঙুলের ইশারায় বলে দেব, "বাদ মে আইয়ে জনাব"। সবাই সেই ডায়োজিনিস-আমিকে দেখে বলবে "কী জিনিস রে ভাই"। 

এমন সময় ঘ্যাম-শিরোমণি সম্রাট-শ্রেষ্ঠ শ্রী শ্রী আলেকজান্ডার উত্তমকুমারিও হাসি হেসে আমার সোফার দিকে এগিয়ে আসবেন। মেজপিসে যে মেজাজে বৃষ্টির দিনে ফুলুরি খাওয়ান, আলেকজান্ডারবাবু তার চেয়েও সহজে বখশিশ বিলিয়ে বেড়ানো মানুষ। রাজ্য চাইলে রাজ্য, রাজকন্যে চাইলে রাজকন্যে। তুষ্ট করতে পারলেই হল। আলেকজান্ডারবাবুকে এগিয়ে আসতে দেখে বন্ধুরা ভাববে, এ'বার এই ডায়োজিনিস ব্যাটার ঘ্যাম-ঘুম ভাঙবেই। প্রতিবেশীরা চিল্লিয়ে উঠবে, "এ'বারে বাবুটি সোফা ছেড়ে উঠবেই। আলেকজান্ডারের ঝিলিক দেখে যাবে গলে। এ'টা দাও ও'টা দাও বলে মারাত্মক দাঁও মারার তাল করবেই"।

গ্রেটস্য গ্রেট আলেকজান্ডার এসে দাঁড়াবেন সোফার সামনে। বিশ্বজয় করা আওয়াজ দিয়ে চমকাতে চাইবেন, "এই যে ব্রাদার, হিয়ার আই অ্যাম। কী চাই? মুখ ফুটে যাই চাইবে, পাবে। মাইরি। কী চাই, অ্যাঁ? কেরিয়ার পালটে দেওয়া সুযোগ? না লটারিতে পাওয়া মিক্সার গ্রাইন্ডার? নাকি পরশপাথর,? না গানের গলা? না মার্গো সাবানের সুপারসেভার প্যাক? নোবেল প্রাইজ চাই? তাও হবে। নাকি ভোটে জিততে মন চাইছে"? এ'সব প্রশ্ন ভাসিয়ে দিয়ে, নিজের আদ্দির পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াবেন আলেকজান্ডার। একটা সিগারেট ধরিয়ে নিখুঁত রিং ছাড়তে ছাড়তে আমায় করুণা দৃষ্টি দিয়ে জরীপ করবেন। শিস দিয়ে ধরবেন সলিল চৌধুরী। 

তারপর ফের বলে উঠবেন, 
"ভাই ডায়োজিনিস, লজ্জা কীসের। এই তো বাম্পার সুযোগ। মন খুলে চেয়ে নাও দেখি। তোমার ন্যাতানো হাবভাব আমার পছন্দ হয়েছে। হৈহল্লায় হাঁপিয়ে উঠছিলাম কিনা। তাই বলছি। চিন্তার কিস্যু নেই। চেয়ে ফেলো। মনঃপ্রাণ খুলে"। 

সোফা-মগ্ন আমি ঘাড়ের অ্যাঙ্গেল সামান্য পালটে নিয়ে আলেকজান্ডারের দেবতার মত মত উজ্জ্বল চেহারাটার দিকে তাকাব। বলব, "চেয়ে ফেলব? চেয়ে ফেলব কী"?

সিগারেটে একটা মোক্ষম টান দিয়ে আলেকজান্ডার বলবেন "চেয়েই দেখো না। আলেকজান্ডারের কথা হেরফের হলে পৃথিবী রসাতলে যাবে"। এরপর পকেট থেকে একটা পান বের করে মুখে দেবেন, জর্দার মনমাতানো সুবাসে ঘর মাতোয়ারা হবে। 

আবারও বলব, "ভেবেই দেখুন, পরে আবার রিফিউজ করবেন না যেন"।

আলেকদাদার আশ্বাস; "আহ্‌। বললাম তো ডায়োজিনিস ভাইটি। চাও। ডিম্যান্ড করো। ক্যুইক"। 

এ'বার আমার পালা হাইভোল্টেজ উত্তম-হাসিতে নিজেকে মুড়ে নেওয়ার। ডায়োজিনিস-কেতায় আমি বলে উঠবো, "স্যার, ডিমান্ডটা ফেলবেন না প্লীজ। ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বাতির স্যুইচটা বন্ধ করে যাবেন। ইলেকট্রিকের বাতি আমেজে একটু খোঁচা দিচ্ছে বটে। আর পারলে তার আগে ওই ফ্রিজ থেকে একটা জলের বোতল  বের করে আমার হাতের কাছে দিয়ে যান। এ'বেলাটা তা'হলে আর না উঠলেও হবে। দ্যাট ইজ অল"। এই বলে আমি গা আরও খানিকটা এলিয়ে নিয়ে ফের চোখ বুজব। 

তালেবর আলেকজান্ডার ততক্ষণে থ। পান চিবুনো থেমে গেছে। এ যেন দক্ষিণপাড়ার বালক সঙ্ঘ ক্লাবের ক্যারমখোরদের কাছে তার সৈন্যদল ইনিংস ডিফীট খেয়েছে। দু'একবার আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাবেন। কিন্তু সম্রাটের মুখ দিয়ে টু-শব্দটি বেরোবে না। খানিকক্ষণ অসহায় ভাবে ঘরের মধ্যে পায়চারী করে, ফ্রিজ থেকে জলের বোতল বের করে আমার সোফার পাশে রেখে রণেভঙ্গ দেবেন রাজাধিরাজ। আমার প্রতি অন্তত বাহাত্তরটা সেলাম ঠুকবেন, তবে মনে মনে। রুম থেকে বেরোনোর আগে স্যুইচ বোর্ডে হাত রেখে আর একবার আমার দিকে তাকিয়ে সেই বিশ্বজয়ী বলবেন, " আলেকজান্ডার হয়ে ছাই করলামটা কী! এমন নির্লোভ হতে পারলাম না কেন?আমি ডায়োজিনিস হতে পারলাম না কেন"?

বড় শখ জানেন। বড় সাধ; জীবনে একটিবার অন্তত এমন ডায়োজিনিস-ঘ্যাম নিয়ে জীবনের কোনও একটি আলেকজান্ডারিও বখশিশের অফার উড়িয়ে দেব। একটিবার অন্তত সে ঘ্যাম যেন স্পর্শ করতে পারি।

(আলেকজান্ডার-ডায়োজিনিসের মোলাকাতের ওপর যে উইকিপিডিয়া এন্ট্রি, সে'টার লিঙ্ক কমেন্ট সেকশনে দেওয়া রইল। আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন)

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

ব্লগ-বাজ

আর চিন্তা নেই । বাঙালিকে আর রোখা যাবে না । আর সামান্য (সম্ভবত কিঞ্চিত গোলমেলে ) কবিতা ছাপাবার জন্যে সম্পাদক কে তোল্লাই দিতে হবে না । আর প্রেমে লটরপটর হয়ে ডায়েরি লিখে প্রাণপাত করতে হবে না। পলিটিক্স কে পাবলিক-জন্ডিস বলে গাল দেওয়ার জন্য আর “প্রিয় সম্পাদক” বলে আনন্দবাজারের ঠ্যাং ধরতে হবে না। কেন ?  হোয়াই? বাঙালি ব্লগিং শিখে গ্যাছে যে। ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে শাণিত তলোয়ারের মত “ পোস্ট”-সমূহ জনতার ইন্টেলেক্ট এসপার-ওসপার করে দেবে ; হাতে-গরম গায়ে-কাঁটা। বাঙালি মননের নব্য জিস্পট ; ব্লগ-স্পট । কে বলে যে বাঙালি ব্রিগেডে বুক্তুনি দিয়ে আর ফুটবল মাঠে খেউড় করে খতম হয়ে গ্যাছে ? কে বলে যে বাঙালির ঘিলু কফি হাউসে ভাত ঘুমে মগ্ন ? বাঙালিকে একবার ব্লগখোর হতে দিন , সমস্ত অভিযোগ ভ্যানিশ হয়ে যাবে । পোপ থেকে পরশুরাম ; ডেঙ্গু থেকে মশাগ্রাম ; বং-ব্লগের দাপট রইবে সর্বত্র । বাঙালির সমস্ত আশা-ভরসা-জিজ্ঞাসা এইবারে ব্লগ মারফত্‍ পৌছে যাবে ট্যাংরা ট্যু টেক্সাস । তোপসে মাছের স্প্যানিশ ঝোলের রেসিপি কী ? বাঙাল-ঘটি মিল মহব্বত-হয়ে গেলে কি বাঙ্গালিয়ানা চটকে যাবে ? নেতাজী কি এখ

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু