Thursday, June 16, 2022

গুড়ুম



১।

খুব রাগ হলে ভাস্কর পায়চারি করেন। অফিসের কিউবিকল থেকে উঠে পায়চারী করাটা ঠিক শোভনীয় নয়, লোকে বাঁকা চোখে দেখবে। তা'ছাড়া বিস্তর কাজও বাকি আছে। কাজেই চেয়ারে বসেই একটা মৃদু দুলুনির  মাধ্যমে নিজের রাগটাকে ম্যানেজ দিতে হল। অবশ্য রেগে গেলে টাইপিং স্পীড বেড়ে যায় ভাস্করের। তা'বলে অ্যাকিউরেসি কমে না। সে'টা একটা ভালো জিনিস।

আপাতত রাগটা হয়েছে অভীক সামন্তর ওপর; ভদ্রলোক ভাস্করের বস। বয়সে ভাস্করের চেয়ে বছর দশেক ছোটই হবে। ভাস্করের মতে অত্যন্ত স্মার্ট ছেলে, তার ওপর চনমনে। কর্পোরেট জগতে আলো করে থাকার সমস্ত গুণই আছে। কিন্তু বয়স কম, মাঝেমধ্যেই উত্তেজিত হয়ে পড়ে। আর তখনই গোল পাকায়। এই যেমন খানিকক্ষণ আগে সে ভাস্করের ওপর বিস্তর চ্যাঁচামেচি করলে। রেগে গেলে আবার চোস্ত ইংরেজিতে ধমক কষায় অভীক। ভাস্করের তৈরি করা একটা রিপোর্টে সামান্য ভুল রয়ে গেছিল। ব্যাপারটা সামান্যই। অভীক মাথা ঠাণ্ডা রাখতেই পারত, এই ভুল সামাল দেওয়া কোনও বড় ব্যাপার নয়। কিন্তু ওই, রগচটা মানুষ। যা নয় তাই বলে অন্তত মিনিট কুড়ি তম্বি করলে, আর পাঁচটা সহকর্মীর সামনেই। ভাস্কর একবার ভেবেছিলেন কড়া উত্তর দেবেন। সময়মত প্রমোশন পেলে এখন তাঁর অভীকের ওপরেই গ্যাঁট হয়ে বসে থাকার কথা। কিন্তু কপাল জিনিসটা বড় নির্মম। তা'ছাড়া প্রমোশন সময়মত না হলেও, এ ডিপার্টমেন্ট এখনও ভাস্কর ছাড়া অন্ধ, এ কথা অভীক ভালো মত জানে। সামান্য একটা ভুলের জন্য এই বাড়াবাড়ির কোনও মানেই হয়। কিন্তু হাজার রকম উত্তর মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করেও মুখ ফুটে বলা হল না। নিজের নোটবুকে খসখস করে পেন চালিয়ে গেলেন, লেখার ভান করে। ও'দিকে অভীক টেবিল চাপড়ে বিস্তর কথা শুনিয়ে গেল। চ্যাঁচামেচি থামলে চুপচাপ অভীকের চেম্বার থেকে বেরিয়ে নিজের কিউবিকেলে এসে আড়াই মিনিট  গুম হয়ে বসেছিল ভাস্কর। তারপর শুরু হল দুলুনি আর খটরখটর টাইপিং। 

খানিকক্ষণ আগে মুরারি চা দিতে এসেছিল, মুরারির দেঁতো হাসি দেখে অকারণেই ভাস্করের রাগটা চড়াত করে আরও খানিকটা বেড়ে গেল যেন। ভেবেছিলেন চিৎকার করে বলবেন, "আমি কাজ করছি। তা'তে অত হাসির কী আছে"? কিন্তু ওই, মুরারি বেচারির ওপর অকারণ খিটখিট করার কোনও মানেই হয়না। কোনোক্রমে সামাল দিয়ে ভাস্কর বলেছিলেন, "আজ লিকার চা থাক। ভালো করে কফি করে আনো দেখি। ব্ল্যাক নয়"।

২। 

হাওড়া স্টেশনের সাত নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকার সময় এক ভদ্রলোক অকারণেই পা মাড়িয়ে দিলে। ভাস্করের মনে হচ্ছিল ঠাস করে একটা চড় মারতে। আদৌ তেমন ভিড় নেই যে তাঁর পায়ের ওপর এসে পড়তে হবে।  পা মাড়ানো ভদ্রলোক অবশ্য মাথা ঘুরিয়ে একটা বিগলিত সরি বললেন। ভাস্কর ভাবলেন গলা উঁচু করে বলবেন, "আচ্ছা ক্যালাস লোক তো মশাই আপনি। সিভিক সেন্সের এতই অভাব"? কিন্তু কী মুস্কিল, মুখ দিয়ে বেরোল, "আরে সরির কী আছে। স্টেশনে, বাস-স্ট্যান্ডে এ'সব হামেশাই হচ্ছে তো। আপনি তো আর ইচ্ছে করে করেননি। রিল্যাক্স, ইট ইজ ওকে"। 

আজ কপাল ভালো ট্রেনের বসার জায়গা জুটেছিল। নিজের রাগরাগ ভাবটা ভিতর থেকে বড় ট্রাবল দিচ্ছিল ভাস্করবাবুকে। ইচ্ছে হল আদা লজেন্স খাওয়ার, ও'তে মন খানিকটা ঠাণ্ডা হতে পারে।  সেই মত এক প্যাকেট কিনলেন। দশটাকায় পাঁচটার প্যাকেট। কুড়ি টাকার নোট এগিয়ে দিলেন, ফেরত পেলেন একটা দশটাকার নোট আর লজেন্সের প্যাকেট। কিন্তু পকেটে রাখতে গিয়ে টের পেলেন দশটাকার নোটটা অর্ধেক ছেঁড়া। জুতোতে ইচ্ছে করছিল লজেন্সওলাটাকে যে ইতিমধ্যে ট্রেনের ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে অন্য কাস্টোমারের সামনে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আওয়াজ দিতে গিয়েও দিলেন না। কী হবে ঝামেলা বাড়িয়ে। কচি বয়সের ছোকরা। তা'ছাড়া দশটাকাই তো, ওকেও তো কোনও কাস্টোমারই গছিয়ে দিয়ে সরে পড়েছে। যাক গে। লজেন্সে কনসেন্ট্রেট করলেন ভাস্কর। কিন্তু মনমেজাজটা সত্যিই গোলমেলে অবস্থায় ছিল, লজেন্সের স্বাদটা ঠিক উপভোগ করতে পারলেন না। 

৩। 

অফিসের ব্যাগট্যাগ রেখে বাথরুমের দিকে এগোতে যাবেন ভাস্কর, এমন সময় চন্দ্রাণী জিজ্ঞেস করল, "বাজার করে ফিরবে বলেছিলে যে"। 

থমকে দাঁড়ালেন ভাস্কর। বললেন, "বাজার করেছি তো। হাওড়াতেই। আধকিলো পটল, আধকিলো ঢ্যাঁড়স, এক আঁটি পালং, এককিলো বেগুন, অল্প বিটগাজর। খানিকটা পেঁয়াজ। একশো গ্রাম কাঁচালঙ্কা। ঠিক যেমন বলে দিয়েছিলে"।

"সবজি কিনলে তো সে'গুলো গেল কই"? চন্দ্রাণী আকাশ থেকে পড়লে। 

"থলেতে রেখেছি। অবভিয়াসলি"। গলা মিইয়ে এলো ভাস্করের। 

"আর থলেটা কই"?

"বর্ধমান লোকালের ইঞ্জিনের দিক থেকে চার নম্বর কামরার ওপরের একটা বাঙ্কে। এতক্ষণে বোধহয় চুঁচুঁরা ছাড়িয়ে এগিয়ে গেছে। ওরা অনেকদূর যাবে"।

চন্দ্রাণীর ক্লান্ত মুখটা দেখে বড় কষ্ট হল ভাস্করের। কথা না বাড়িয়ে গামছা কাঁধে সোজা বাথরুমে ঢুকলেন তিনি। ফ্ল্যাটবাড়ির ঘুপচি বাথরুম। সেই স্বল্প পরিসরেই ভাস্কর পায়চারী করলেন খানিকক্ষণ। পায়চারীর স্পীড বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর রাগ খানিকটা কমে আসছিল বটে। এমন সময় একটা আছাড় খেতে হল।  ভাস্করের চোখের সামনের আলোটুকু সাফ হয়ে পড়ে রইল বিকট অন্ধকার। 

৪।

জ্ঞান যখন ভাঙল তখন ভাস্কর সাদা ধবধবে বিছানায় শুয়ে। চারপাশে দেওয়ালের রঙ সাদা। সমস্তকিছুই সাদা, এতই সাদা চারপাশটা যে চোখে ধাঁধা লাগে। শরীরে ব্যথাবেদনা কিছু আছে বলে তো মনে হল না। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলেন ভাস্কর। চন্দ্রাণী আশেপাশে নেই। কোনও নার্স ডাক্তারও নজরে পড়ল না। শুধু এক হাফ শার্ট পরা ভদ্রলোক একটা চেয়ারে গা এলিয়ে একটা নোটবুকে কিছু লিখছিলেন। 

ভাস্কর সামান্য কাশলেন। চেয়ারে বসা ভদ্রলোক মুখ তুলে তাকালেন। এক মাথা টাক, একটা পেল্লায় গোঁফ,আর এমন ঢুলুঢুলু চোখ ভাস্কর আগে দেখেছেন বলে মনে পড়ল না। কিন্তু ভদ্রলোক নেশা যে করেননি সে'টা ওর গলার স্বর শুনেই বোঝা গেল। 

"এই যে ভাস্করবাবু। উঠে গেছেন? ভেরি গুড"। 

"এ'টা কোন নার্সিং হোম"?

"আবার সেই এক প্রশ্ন। আরে, এ'টা হসপিটাল নয়। গুড়ুম সেন্টার। 

"কী সেন্টার"?

"গুড়ুম সেন্টার। তা, এখন কেমন বোধ করছেন"?

"একটু পিপাসা পাচ্ছে বোধ হয়। তবে আর কোনও অসোয়াস্তি তো বোধ করছি না। ইয়ে, আপনাকে তো ঠিক..."। 

"ও। আমি হদ্বুইচ। আমিই আপনার গাইড। চলুন"। 

"কীসের গাইড"?

"চলুন না। ফের বুঝিয়ে বলছি'খন। টাইম ওয়েস্ট করলে হবে না। আসুন। উঠে আসুন"। 

৫। 

হদ্বুইচ ভাস্করকে একটা গুমোট ঘরে নিয়ে এলে। এ ঘরে আবার এক বিন্দুও সাদা নেই। চারপাশে আবছা অন্ধকার, ঘোলাটে একটা হলুদ আলো সে অন্ধকারকে আরও বিশ্রী করে তুলছে। চোখ সওয়াতে সময় লাগছিল ভাস্করের। ও'দিকে ঘরে ঢুকেই হদ্বুইচ জোর গলায় বললেন,"নিন ভাস্করবাবু, কাজ সেরে ফেলুন। ক্যুইক"।

চোখ কুঁচকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর ভাস্করবাবু টের পেলেন যে তাঁর সামনে খান পাঁচেক পেল্লায় কাঠের চেয়ার পাতা আছে। আর সে চেয়ারে বসা মানুষগুলোকে দেখে তাঁর চোখ কপালে উঠল। তাঁরা প্রত্যেকেই পিছমোড়া করে বাঁধা। আর প্রত্যেকেই যেন রণক্লান্ত, মাথা নুইয়ে বসে। একটা চেয়ারে অভীক সামন্ত, একটা চেয়ারে মুরারি, তিন নম্বর চেয়ারে ট্রেনের লজেন্সওলা। চার নম্বর চেয়ারে বসে আছেন হাওড়া স্টেশনের সেই পা মাড়ানো ভদ্রলোক। আর শেষ চেয়ারে বসে যে ঝিমোচ্ছে,সে ভদ্রলোক নির্ঘাত ভাস্কর নিজেই। কী সাংঘাতিক। ড্যাবড্যাবে চোখে নিজের সামনে বসে থাকা নিজেকে দেখছিল ভাস্কর। এমন সময় হদ্বুইচ একটা গলার স্বর উঁচু করে বললেন, "নিন, কাজ সেরে ফেলুন চটজলদি"। 

"কী কাজ"? আকাশ থেকে পড়লেন পাশে দাঁড়ানো ভাস্কর। 

"উফ, রোজ রোজ এই একই কথা বোঝাতে আমার ভালো লাগে না", হদ্বুইচ যেন প্রায় অভিমানের সঙ্গে বললেন। 

আর তক্ষুনি মনের মধ্যে আদত ব্যাপারটা ঝড়ের গতিতে স্পষ্ট হয়ে উঠল। এই গুড়ুম সেন্টারে যে মাঝেমধ্যেই ঘুরে যান যে ভাস্কর। হেসে ফেললেন তিনি। 

"কী অন্যায় বলুন দেখি হদ্বুইচ । তোমার এই গুড়ুম সেন্টারে বারবার আসি অথচ প্রতিবারই ভুলে মেরে দিই"। 

"আপনি ভারি ইয়ে মশাই। যাকগে, এ'দের ওপর জমানো রাগ সব ঝেড়ে বের করুন দেখি। ক্যুইক। চড়থাপ্পড় দু'একটা চালাতে ইচ্ছে করলে রেয়াত করবেন না"। 

"হদ্বুইচ, তুমি তো জানো। সে আমার দ্বারা হওয়ার নয়"। 

"আরে ধুর মশাই। রাগ নিয়ে কিপটেমো করতে নেই"।

"আমি আসি হদ্বুইচ । তুমি তো জানো, এ কাজ আমি করব না। কেন যে খামোখা আমায় এই গুড়ুম সেন্টারে ধরে আনো বারবার"। 

"এ'সব আমার সহ্য হয়না একদম। আরে বাবা, রাগ কি ফিক্সড ডিপোজিট নাকি যে ভাঙানোর ব্যাপারে এত ইয়ে। দিন না এ ব্যাটাদের ধরে দু'ঘা। দিন না। আপনি চাইলে এনে দিচ্ছি একগাছা বিছুটি"। 

"হদ্বুইচ, অভীকের কাল বিবাহবার্ষিকী। ছুটি চেয়েছিল দু'দিনের, ওপরওলা নাকচ করে দিয়েছে। হাইয়ার রোল, হাইয়ার রেস্পন্সিবিলিটি, এই বয়সে। নট ইজি। নট ইজি। ওই মুরারিকে যে দেখছ, ওর নিজের বাপ-মা মরা ভাইপো ভাইঝিকে সন্তান-স্নেহে বড় করছে। নিজের ছেলেমেয়েদের পাশাপাশি, একইরকম যত্নে। কতই বা মাইনে পায় বলো, অথচ মুখের হাসিটা যাওয়ার নয়। ওই যে পা মাড়ানো ভদ্রলোক, ওর কাঁধের ঝোলাটার ওজন দেখেছ?নির্ঘাত লোহাটোহা বয়ে রোজ ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করছে। বাপ রে বাপ! অথচ আমি লারেলাপ্পা একটা ব্রিফকেস আর সবজির ব্যাগ ব্যালেন্স করতে গিয়ে ব্যাগ ভুলে মেরে দিলাম। এ'দিকে এই ভদ্রলোক কী ওজনটাই না বইছেন। অথচ বয়সে আমার বড়দার চেয়েও বড়। নিশ্চিত। গুরুজন লোক পা মাড়িয়ে সরিও বলেছেন। আর কত চাই বলো। তারপর, এই লজেন্সওলাকে দেখ হদ্বুইচ, ওর বয়স কত হবে বলো বড়জোড় ষোলো? ওর মাধ্যমিক দেওয়ার কথা। সিলেবাসে ডুবে থাকার কথা। সে কিনে ধেড়েদের কাছে ঘুরে ঘুরে লজেন্স বিক্রি করছে। আর ওই যে। ওই শেষ চেয়ারে বসে, আমি। দ্যাখো ভাই। লোকটা আর যাই হোক বদ নয়। মায়ামমতা আছে। অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করতে পারে, অন্তত মাঝেমধ্যে। সে ভদ্রলোক সবজির ব্যাগ ট্রেনে ফেলে আসতে পারে কিন্তু ব্যাটা নিজের সংসারটাকে বড্ড ভালোবাসে। এ'বার এদের রিলিজ করে দাও দেখি। আর আমাকেও তো যেতে হয় হদ্বুইচ। চন্দ্রাণী ওয়েট করছে যে"।

No comments: