Skip to main content

আ গোল্ডেন এজঃ রেহানার মুক্তি ও যুদ্ধ

থার্ড রাইখের ওপর শিরার সাহেবের পাহাড়প্রমাণ (এবং গুরুত্বপূর্ণ) বইটা পড়ার বেশ কিছুদিন পর পড়েছিলাম 'দ্য বুক থীফ'। প্রথম বইটা জরুরী ঐতিহাসিক দলিল। পরেরটা সে ইতিহাসের পটভূমিতে লেখা কাল্পনিক উপন্যাস; এক বইচোর খুকির গল্প। ইতিহাস নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু ইতিহাসের চাকা ঘোরে মূলত তারিখে,  সংখ্যায়, স্মৃতিফলকে এবং রাজনৈতিক মতবাদের হাওয়ায়। এ'টা ইতিহাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ নয় মোটেও; তথ্য ও যুক্তিনির্ভর না হয়ে ইতিহাসের উপায় নেই৷ কিন্তু মানুষের গল্প শুধু তথ্য ও যুক্তি দিয়ে বাঁধা অসম্ভব। মানুষের খিদের গল্প শুধু মন্বন্তরে মৃতের সংখ্যা বা শাসকের শয়তানি বা প্রতিবাদি জনতার প্রতিঘাতের খবর জানিয়ে শেষ হয়ে যায়না। তবে সেই পুরো গল্পটা বলার দায় ইতিহাসের নয়, সম্ভবও নয়। নিজের পাতের খাবার পাশের বাড়ির অভুক্ত শিশুর জন্য সরিয়ে রাখা গৃহিণীর গল্প জমিয়ে রাখার পরিসর ইতিহাসের বইতে নেই৷ পকেটে পিস্তল নিয়ে ঘোরা কোনও অকুতোভয় তরুণ বিপ্লবী যখন  পুরনো চিঠির গন্ধ শুঁকে বারুদের গন্ধ ভুলতে চেষ্টা করে, সে ব্যাপারটা কোনও দস্তাবেজে লিখে রাখা চলেনা। গৃহযুদ্ধে বাপ হারানো ছোট্ট খোকার ফ্যালফ্যালে চোখে শরতের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার গল্প নিয়ে পড়ে থাকলে ইতিহাসের এগোতে পারে না। 

আর সে'খানেই প্রয়োজন সেই ইতিহাসের পটভূমিতে লেখা গল্প-উপন্যাসের। এমন গল্প যা ঐতিহাসিক সত্যের গণ্ডির মধ্যে দাঁড়িয়ে, রাজনৈতিক অস্থিরতা আর 'হেডকাউন্ট' ছাপিয়ে; গেরস্তের হেঁশেল থেকে ভেসে আসা ভাতেভাতের গন্ধ খুঁজে নেবে। লেখকের হিসেব-কষা কল্পনায় সেই গেরস্থালীর হিসেবকিতেব বোঝাটাও বোধ সামগ্রিকভাবে ইতিহাসকে চেনার জন্য জরুরী। 

আর সে'খানেই তাহমিমা আনমের লেখা "দ্য গোল্ডেন এজ" বইটা আমার মনে ধরেছে। লেখিকার একটা সাক্ষাৎকারে শুনলাম যে'খানে তিনি বলছেন যে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল নিজের রিসার্চের ওপর ভিত্তি করে মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটা প্রামাণ্য বই লেখার; অথচ লিখতে লিখতে সে বইয়ের মূল বিষয় হয়ে উঠল মুক্তিযুদ্ধের আবহে লালিত হওয়া কিছু মানুষ ও তাঁদের স্নেহ-ভালোবাসার সম্পর্কগুলো। অথচ ইতিহাসের নিরিখে এ বইয়ের মোটেও গুরুত্বহীন নয়। 

উপন্যাসের শুরু সদ্য স্বাধীন হওয়া পূর্ব পাকিস্তানে, শেষ ১৯৭১য়ের ডিসেম্বরে; বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ দিয়ে। আর গোটা উপন্যাস দাঁড়িয়ে রেহানা হকের  পয়েন্ট অফ ভ্যিউতে৷ বাংলা ভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তান; এ দু'টোই রেহানা পেয়েছেন (এবং ক্রমশ জড়িয়ে ধরেছেন) বিয়ের সূত্রে। জন্মসূত্রে রেহানা উর্দুভাষী এবং কলকাতার মানুষ; কাজেই তাঁর বাংলাদেশকে জড়িয়ে ধরা এবং মুক্তিযুদ্ধে সামিল হওয়ার গল্পটা শুধু জন্মগতভাবে পাওয়া ইডিওলজি আউড়ে নয়। এবং সে'কারণেই; রেহানার পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে মুক্তিযুদ্ধে সামিল হওয়ার গল্প শোনাটা পাঠকের কাছে একটা অনন্য অভিজ্ঞতা। 

স্বামীহারা রেহানার যাবতীয় মুক্তি ও যুদ্ধ তাঁর দুই সন্তানকে ঘিরে। তাঁদের আঁকড়ে ধরেই নিজেকে চিনেছেন রেহানা। প্রয়োজনে নিজেকে ভেঙেছেন, তারপরে আবার নতুন ভাবে উঠে দাঁড়িয়েছেন তিনি; সবটুকুই তাঁর ছেলে সোহেল ও মেয়ে মায়াকে ঘিরে। নিজের দেশ কী ও কোথায়, এ প্রশ্নের উত্তরটুকুও রেহানা খুঁজে নিয়েছেন সোহেল ও মায়ার মধ্যে দিয়ে। "দেশ বা ভাষা মানেই মা আর সে মায়ের জন্য প্রাণপাত করা যায়"; এই চিরকালীন ফর্মুলাকে রিভার্স ইঞ্জিনিয়ার করে এক অন্য ভালোবাসার গল্প বুনেছেন রেহানা। সন্তানের জন্য প্রাণপাত করা মা হিসেবে বাংলাদেশকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিয়েছেন তিনি; সে'টাই তাঁর মুক্তিযুদ্ধ৷ এবং রেহানার মত মানুষের ভালোবাসা যে দেশের জন্য কত জরুরী, সে'টাও এ উপন্যাসে বেশ টের পাওয়া যায়।  রেহানাদের আত্মত্যাগ ও ভালোবাসার গল্প ইতিহাসের বইতে আঁটবে কেন? ঐতিহাসিক উপন্যাস ছাড়া গতি নেই।

আর একটা জায়গায় লেখিকার রিসার্চ এ বইকে সমৃদ্ধ করেছে; সে সময়ের ঢাকা ও সে শহরের বর্ণগন্ধকে সুন্দরভাবে নিজের লেখায় ধরেছেন তিনি। আমি ঢাকায় যাইনি কোনওদিন। তবে ধানমণ্ডি বা গুলশন গোছের নামগুলো মাঝেসাঝে পড়েছি বা শুনেছি। কিন্তু এই উপন্যাস পড়ে যেন মনে হচ্ছে যে জায়গাগুলো একবার ঘুরে না এলেই না। না না, ভৌগোলিক ডিটেলিং তেমন নেই এ লেখায়; তবে ওই জায়গাগুলোকে কেন্দ্র করে বহু ছোটছোট ঘটনার এমন সুন্দর করে গোটা বইতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যে বইটা শেষ করার পর মনে হচ্ছে যেন জায়গাগুলো যেন আর পাঁচটা চেনা শহুরে পাড়ার মতই। তাছাড়া জবাকুসুম তেলের সুবাস থেকে  বিরিয়ানি হয়ে ইলিশ বা ডাল-বেগুনভাজার চনমন ও পাড়ার আড্ডার অত্যন্ত সুরসিক বর্ণনা এ বইতে রয়েছে। ডিটেলিংয়ে কিছু খুচরো খুঁত যে নেই তা হলফ করে বলতে পারি না৷ তবে পড়তে গিয়ে সুর কাটবে, তেমন কিছু গলদ আমার অন্তত নজরে পড়েনি।  

দু'টো কথা বলে শেষ করি। 

এক।
আমি এ বই অডিওবুক হিসেবে শুনলাম। মধুর জাফরির কণ্ঠে রেহানার গল্প শুনতে চমৎকার লাগল। বিশেষত এ উপন্যাসে এ'দিক ও'দিক ছড়িয়ে থাকা বাংলা শব্দগুলো দিব্যি উচ্চারণ করেছেন তিনি।

দুই।
কোনও গল্পের বই পড়ে ভালো লাগলে তা নিয়ে দু'চার কথা চট করে লিখে ফেলবার পিছমে একটা গুরুতর কারণ আছে। সে লেখা পড়ে দু'একজন যেমন সে বই উল্টেপাল্টে দেখতে চাইতে পারেন, তেমনই সহৃদয় কেউ সে লেখার সূত্র ধরেই হয়ত আমায় অন্য ভালো বইয়ের খবর দেবেন। ওই হল গিয়ে আমার আখেরে লাভ৷ 'নেমসেক' নিয়ে দু'দিন আগে সাহস করে দু'চার কথা লিখেছিলাম। সে'টা পড়ে এক দাদা বললেন "তাহমিমা আনমের দ্য গোল্ডেন এজ বইটা পড়েছ ভায়া"? 
পড়া ছিল না, পড়ে নিলাম; একেই বলে মুনাফা। 

পুনশ্চ: এই বইটি একটা ট্রিলোজির প্রথম অংশ।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু