Skip to main content

"দ্য লোল্যান্ড" প্রসঙ্গে


যিনি "দ্য লোল্যান্ড" রেকমেন্ড করেছিলেন তিনি এককথায় এ উপন্যাস সম্বন্ধে বলেছিলেন; "বিষাদসিন্ধু"।

বিষাদসিন্ধুতে যে মিঠে রোদ্দুর এসে মিশেছে, সে'টা টের পেতে হল বইটা পুরো পড়ে। ঝুম্পা লাহিড়ীর লেখা আমি সদ্য পড়েছি। কিছুদিন আগে পড়েছিলাম 'নেমসেক' আর দু'তিনদিন আগে শেষ করলাম নেমসেক। সে বই সম্বন্ধে চারটে মনের কথা।

১।

কলকাতা সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে ক্লিশেয় মাখামাখি হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। মনে রাখতে হবে যে লাহিড়ীর পাঠক আন্তর্জাতিক; তাঁদের কাছে যে ধরণের কলকাতা বিষয়ক ডিটেলিং চমৎকার  ঠেকবে, বাংলার (এবং কলকাতার) বাঙালির কাছে সেই ডিটেলিংই ক্লিশে ভারে ক্লিষ্ট মনে হতে পারে৷ কিন্তু লাহিড়ীর গুণ সে'খানেই। তাঁর বর্ণনা প্রায় নিখুঁত, বাহুল্যবর্জিত আর তাঁর ভাষা প্রাণবন্ত।  কলকাতার যে'টুকু তাঁর লেখায় ফুটে ওঠে, সে'টুকু পড়লে আজীবন কলকাতায় বন্দী কোনও মানুষেরও দিব্যি ভালো লাগবে বলে আমার মনে হয়। অফিস যাওয়ার পথে রোজ টালিগঞ্জ পেরিয়ে যাই, এ বইতে টালিগঞ্জ একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ক'দিন ধরে যখনই টালিগঞ্জ পেরোতে হয়, 'দ্য লোল্যান্ড'য়ের সুভাষ, উদয়ন আর গৌরীর কথা মনে পড়ে। বেলা নামের এক কিশোরীর কথা মনে পড়ে যার টালিগঞ্জের সঙ্গে যোগাযোগ মাত্র কয়েকদিনের। আর হ্যাঁ, নেমসেকের কলকাতার তুলনায় লোল্যান্ডের কলকাতার ব্যপ্তি অনেকটা বেশি। 

 ২। 

বিষাদে মিঠে রোদ্দুরের ব্যাপারটা সামান্য খোলসা না করলেই নয়। লোল্যান্ডে আমার সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র গৌরী। সে আদর্শ বলে নয়। বরং তাঁর ভুলভ্রান্তিগুলোই এ উপন্যাসের মূল রসদ। সত্যি কথা বলতে কী উপন্যাসের মূলে রয়েছে একটা অস্থির সময় আর ক্যাটালিস্ট হয়ে উঠেছে গৌরীর অন্ধকারটুকু। কত মানুষের ঘেন্না, রাগ আর বিরক্তি সামাল দিয়ে গৌরী পথ হেঁটেছেন। একদিকে যেমন ভালোবেসেছেন, অন্যদিকে প্রকাণ্ড সব ভুলও করেছেন৷  হলফ করে বলতে পারি যে একসময় পাঠকের সমস্ত রাগ এসে পড়বে গৌরীর ওপর। কিন্তু সেই উপন্যাসের এই কাল্পনিক চরিত্রটি যেন ভালো থাকে, যেন সামান্য স্বস্তি খুঁজে পায়; এ আশাটুকুও পাঠকের বুকের মধ্যে আনচান তৈরি করবেই। লাহিড়ীর লেখায় যে অসাধারণ 'এমপ্যাথি' রয়েছে, তার মাধ্যমেই গৌরীকে ভালোওবাসবেন কিছু (বা বেশিরভাগ) পাঠক। 

৩। 

বাপ-ছেলের সম্পর্ক নিয়ে কত লেখা পড়ি। বাপ মেয়ের ভালোবাসাটুকুর ওম অনুভব করার জন্য এ বই হয়ত আবার পড়ব। সুভাষের বেলাকে আঁকড়ে রাখা আর বেলার ভেসে যেতে চেয়েও ভেসে না যাওয়া, এ'সবটুকুর মধ্যেই সুভাষের ভালোবাসা। হেঁয়ালি বা স্পয়লার নয়; তবু বলি যে সুভাষ সে অর্থে বেলার বাবা নন৷ আবার সুভাষ যে ভাবে বেলার পিতা হয়ে উঠতে পেরেছেন, বাপ-মা দু'জনের ভালোবাসা জুড়লেও বোধ হয় সুভাষের স্নেহের গভীরতার সঙ্গে তুলনা চলেনা।  হয়ত এমন একটা সময় আসে যখন বৃদ্ধ বাপ-মা সন্তানের স্নেহের মধ্যে আশ্রয় খোঁজেন৷ সুভাষকে সে আশ্রয় দিয়ে নিজের বুকে টেনে নিয়েছিল বেলা, মায়ের মতই। বুকে টেনে নিয়ে আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে সে বাপ কা বেটি আর কী। 

৪। 

গল্পের পরিসর চল্লিশের দশকের কলকাতা থেকে ইন্টারনেট সমৃদ্ধ আধুনিক দুনিয়া। এসেছে নক্সাল আন্দোলন প্রসঙ্গ৷ এসেছেন উদয়ন নামের এক উজ্জ্বল তরুণ, হারিয়েও গেছেন৷ খুন হন উদয়ন, নিজের বাবা মা ও স্ত্রীর চোখের সামনে। সে মৃত্যুর মেঘ আবছায়ায় ভরে দিয়েছে গোটা উপন্যাস। সে মৃত্যুর যন্ত্রণা বয়ে বেড়িয়েছেন উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র। উদয়নকে ভালোবাসা প্রতিটি মানুষ সে যন্ত্রণায় একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে রইলেন অথচ একে অপরের হাত ধরতে পারলেন না। সেই পাহাড়প্রমাণ মনখারাপের মধ্যেই এই ভালোবাসার উপন্যাস। বার বার ফিরে এসেছে উদয়নের মৃত্যু, উপন্যাস শেষও হয়েছে সেই মৃত্যু আর একটা ব্যর্থ আন্দোলনের যন্ত্রণায়৷ কিন্তু মৃত্যু আর যাবতীয় ব্যর্থতা পেরিয়ে এ উপন্যাসে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ভালোবাসা আর কলকাতার গল্প৷

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু