Saturday, May 9, 2020

পঁচিশে বৈশাখ আর নৈবেদ্য


আজ সারাদিন ফেসবুক ও ট্যুইটার রবিপ্রণামে ভরপুর। আঁকা, পাঠ, গান, নাচ থেকে কার্টুন পর্যন্ত; যোগ দিয়েছেন সব বয়সের মানুষ৷ আর এ'সব কিছু আমার যে কী ভালো লাগল। কত চেনা মানুষ হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে বসেছেন বা খালি গলায় গান ধরছেন, কত খোকাখুকু কী অপূর্ব ভাবে কবিতা আবৃত্তি করছে, ঘরের মধ্যে বা ছাতের ওপর হয়ত কেউ নেচেছেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরে। 

এক সময় মনে হত; আমাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে গেলানোর একটা প্রবণতা আছে। হয়তো আছেও বা৷ কিন্তু এখন মনে হয় এই যে এত মানুষ সাহস করে গান গেয়ে উঠছেন, কবিতা পড়ছেন, ছবি আঁকছেন; সে সাহসের মূল্য অসীম। এবং সেই গাওয়া গান বা পাঠ করা কবিতা সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া; সে সাহস খানিকটা যুগিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। বাড়ির ড্রয়িং রুমে বসে কেউ দড়াম করে গাইতে বললে অনেকেরই অস্বস্তি হয়; দুম করে ওই ভাবে গাওয়া যায় না নাচা যায়? কিন্তু এই স্মার্টফোন আর ফেসবুক/ট্যুইটার গোছের প্ল্যাটফর্ম মিলেমিশে; ব্যাক্তিগত স্পেস আর এক্সপোজার ব্যালেন্স করে একটা চমৎকার সুযোগ করে দিয়েছে।  

ফেসবুক জমানার আগে জানতাম পাড়ার স্টেজে বসে হারমোনিয়াম বাজাতে যে পারবে না তাঁর গান পাতে দেওয়া চলে না; রবিস্যারের গান হলে তো নয়ই। এখন সে ব্যাপারটা আমি একটু অন্যরকম ভাবে বুঝি। আমি ছাই গানবাজনার কিছুই তো বুঝি না। কিন্তু এ'টুকু বেশ টের পাই যে একজন মানুষ ভালোবেসে গান গাইছেন; এই গোটা ব্যাপারটা চাক্ষুষ করার মধ্যেও রয়েছে একটা দুর্দান্ত থ্রিল। নাচের ন'টুকুও  বুঝি না, কিন্তু এক ছোট্টখুকি তাঁর দিদিমার সঙ্গে ফুলে ফুলে ঢলে চলেছে; তার সৌন্দর্য বর্ণনা করার ক্ষমতা থাকলে আমি নভেলিস্ট হতাম।   এ দিনটা ফেসবুকে এমনভাবে ডালপালা বিস্তার না করলে জানতেই পারতাম না পাড়ার খিটখিটে জ্যেঠু হারমোনিয়ামের সামনে বসলে পান্তুয়া মেজাজের সলজ্জ মিঠে হাসি আবিষ্কার করে ফেলেন। 

মোদ্দা কথা হল, আজ গোটদিন ফেসবুক দারুণভাবে সরগরম ছিল। পরনিন্দায় নয়, গায়ে ফোস্কা ফেলা সারকাজমে নয়, 'তুমি রাস্কেল তোমার গুষ্ঠি রাস্কেল' গোছের ভার্চুয়াল কলারটানা ঝগড়ায় নয়; সে সরগরম নাচে, গানে আর কবিতায়। শিল্পীদের অনেকেই তুরীয়, তাঁদের তাক করে আমার মত নন-সমঝদারের ছুঁড়ে দেওয়া 'কেয়াবাত'টুকু প্রায় ধৃষ্টতা। কিন্তু এমন অনেকে আছেন যাদের হয়ত পাড়ার রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যায় স্টেজে ওঠা হয়নি কিন্তু গান, কবিতা বা নাচের প্রতি তাঁদের অপত্য ভালোবাসাটুকু আছে। আর আছেন রবীন্দ্রনাথ৷ রবিস্যারের লেখা কতটা গুলে খেলে তাঁকে চেনা যায়? আমি রবীন্দ্রনাথ এতটাই কম পড়েছি যে সে ফর্মুলা নিয়ে দু'কথা বলার সাহস আমার নেই। তবে বারান্দার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে যে মানুষটা রবিস্যারের গান আনমনে গুনগুন করতে গিয়ে বুকে আরামবোধ করেন; রবীন্দ্রনাথের ওপর তাঁর অধিকার কোনও কালচারজ্যেঠুর চেয়ে কম হওয়া উচিৎ নয়।

যে'টা আগেও বলেছি। সোশ্যাল মিডিয়ে মানুষকে প্রাইভেট স্পেস আর এক্সপোজার মিলিয়ে একটা চমৎকার 'আউটলেট' তৈরি করে দিয়েছে তা অনস্বীকার্য ( নয়ত আমার মত দড়কচা মারা মানুষ এতগুলো লাইন লেখার সাহস পেত কী করে)। আবার সেই সাহসে ভর দিয়েই কত পরিচিত আর অপরিচিত মানুষের গান, নাচ ও আবৃত্তি আজ আমার টাইমলাইনে ভেসে আসছে। এবং আমি বারবার মুগ্ধ হচ্ছি, স্যালুট করছি রবীন্দ্রনাথকে। আমার টাইমলাইনে যারা রবীন্দ্র-প্রণাম ভাসিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেককে আন্তরিক ধন্যবাদ;  চারদিকে এত মনখারাপ আর অন্ধকার সত্ত্বেও আপনারা আজ আমায় ভালো রেখেছেন।

No comments: