Monday, January 6, 2020

পথের দাবী ও ভারতী

 ২০১৯ শেষ করেছি আর একটা রী-রীড দিয়ে। "পথের দাবী" ফের পড়ার মূল কারণ ছিল গোরার পাশাপাশি পথের দাবীর অপূর্ব আর সব্যসাচীকে যাচাই করে নেওয়া। তা দেখা গেল সনাতন ভারত সম্বন্ধে কিছু আলগা ধারণা ছাড়া অপূর্বের সঙ্গে গোরার বাস্তবিকই কোনো যোগাযোগ নেই। 

ইদানীং একটা বড় শিক্ষা আত্মস্থ করার চেষ্টা করছি; কন্টেম্পোরারি সামাজিক ফিল্টারে বসিয়ে ঐতিহাসিক চরিত্রদের বিচার করার দুরূহ কাজটা যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলাই উচিৎ। কাজটা সহজ নয়, সবসময় সম্ভবও নয়; তবে চেষ্টা করতে ক্ষতি নেই৷ গোরা আর অপূর্বর মধ্যে বেশ কয়েক দশকের তফাৎ রয়েছে; সে অর্থে একই ছাঁচে ফেলে তাদের ধর্ম-বিশ্বাসের তুলনা চলে না। তাছাড়া চারিত্রিক দৃঢ়তায় গোরা পালঙ্ক হলে অপূর্ব হল ক্যাম্পখাট। অপূর্বর ধর্ম বিশ্বাস এবং আচারবিচারে নিষ্ঠা তলোয়ারহীন নিধিরামের হাতের ঢালের সঙ্গে তুলনীয় কিন্তু গোরার বিশ্বাসের আগুনে লোহা গলানো যায়। তবে গোরার সে বিশ্বাস যে নেহাৎ  অন্ধ এবং নিরেট নয় তা প্রমাণ করতে এক প্রকাণ্ড নভেল ফাঁদতে হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে।

 বরং গোরা আর সব্যসাচীর তুলনা করে চমৎকৃত হতে হয়৷ কোনো নির্দিষ্ট মতবাদের গণ্ডীর মধ্যে থেকে  ভারতবর্ষকে একটা 'কনক্রিট ডেফিনিশনে' বাঁধতে যাওয়া যে কী অদরকারী; তা এই দুজনের মগজ ঘেঁটে দেখলেই মালুম হয়। নওরোজির ভারত, ভগত সিংহের ভারত, রামমোহনের ভারত আর মোহনদাসের ভারত; কোনোটাই মিথ্যে নয় এবং প্রত্যেকটা ভারতকেই অল্পবিস্তর বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করাটা দরকারী। গোরার ভারতবর্ষ এবং সব্যসাচীর ভারতবর্ষ; দুটোর কোনোটাই হয়ত পুরোপুরি আমার ভারতবর্ষ নয় কিন্তু তাঁদের চোখ দিয়ে ভারতবর্ষের ইতিহাসের দিকে তাকাতে সমীহ-বোধ হয় বৈকি। বিশ্বাস, দেশাত্মবোধ ও মতবাদের দৃঢ়তায় দুজনেই ইস্পাতের ফলার মত ধারালো কিন্তু দুজনেই কিছুটা হলেও ভালোবাসার নরমকে স্বীকার করে নিয়েছেন। তাঁদের সেই ভালোবাসার স্বীকারোক্তির মূলে অবশ্য 'শেষের কবিতা' মার্কা প্রেম নেই। গোরার ক্ষেত্রে সে ভালোবাসার উৎস হল তাঁর প্রাণের বন্ধু বিনয়। সব্যসাচীর ক্ষেত্রে তাঁর সহকর্মী ও নিজের ছোটবোনটির মত প্রিয় ভারতী। 

স্বীকার করে নিই যে পাঠক হিসেবে; গোরা উপন্যাসের বিনয় আর পথের দাবীর ভারতীকেই আমার সবচেয়ে 'ইন্ট্রিগিং' দুটি চরিত্র বলে মনে হয়েছে। দুজনেই সৎ কিন্তু কেউই অবিচল নন; তাঁরা ভালোবাসাকে মতাদর্শের শূলে চাপাতে সর্বদা ব্যগ্র হয়ে বসে নেই। গোরার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি আর উজ্জ্বল আইডিয়ালিজম বিনয়কে ইন্সপায়্যার করছে কিন্তু তাঁকে অন্ধ রোবট করে তুলছে না। ঠিক যেমন সব্যসাচীর মতাদর্শ ও আত্মত্যাগে মুগ্ধ হয়েও ভারতী তাঁর 'মেথড'কে প্রশ্ন করতে কসুর করছেন না। আর সবচেয়ে বড় কথা, বিনয় এবং ভারতী কখনোই নিজেদের নিরেট কনফিডেন্সে মুড়ে রাখছেন না। তাঁরা ভাঙছেন,  মুষড়ে পড়ছেন, তর্ক করছেন, অভিমান করছেন, জড়িয়ে ধরছেন, প্রয়োজনে ক্ষমাও চাইছেন কিন্তু কিছুতেই মানুষের ভালোবাসাকে অবজ্ঞা করছেন না। 

গোরা এবং সব্যসাচী সত্যিই নায়ক, তাঁদের সুপারহিরো বললেও অত্যুক্তি হবে না। কিন্তু আমায় সবচেয়ে বেশি টেনেছে বিনয় এবং ভারতীর চরিত্র। এবং পুরনো বই "রী-রীড"-এর অভ্যাসটা না থাকলে, এ'দুজনকে নতুন করে আবিষ্কার করতে পারতাম কি?

No comments: