Skip to main content

রাজনৈতিক তর্ক

কলকাতার শীতের মতই রাজনৈতিক তর্কে যুক্তির পরিমাণ আশঙ্কাজনক ভাবে কমে এসেছে। অন্যদের সমালোচনা করে কূলকিনারা পাইনা বটে, তবে কালেভদ্রে নিজের স্বীকারোক্তিটুকু টেবিলের ওপরে সাজিয়ে দেওয়াটা উচিৎ বৈকি। (অবশ্য সমস্ত উচিৎ কাজ করতে চাইলেও সমূহ বিপদ, কিন্তু সে আলোচনা অন্যদিন)।

ফেসবুক থেকে টুইটার; নিজের টাইমলাইন মোটের ওপর যে'ভাবে সাজিয়ে নিয়েছি তা'তে এক জবরদস্ত ইকো-চেম্বার তৈরি হয়েছে। আমি বলি "ওহে শোনো, অমুকচন্দ্র আসলে একটি মূর্তিমান শয়তান"। অমনি চতুর্দিক থেকে ইকো ফিরে আসে 'বঢিয়া বোলিয়াছেন', 'এমন করে সোজা কথা সহজ ভাষায় বলতে পারার জন্য অভিবাদন', 'ঘ্যাম বলেছিস' ইত্যাদি। এ'দিকে আমার 'কাস্টোমাইজড' টাইমলাইনও তখন অমুকচন্দ্রের যাবতীয় শয়তানিগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণে পরিপূর্ণ; সে'সব পড়ে আমারও বারবার মন হচ্ছে 'বঢিয়া', 'সাবাশ', 'ঘ্যাম' ইত্যাদি। অমুকচন্দ্রের শয়তানি সম্বন্ধে কেউ সামান্যতম সন্দেহ প্রকাশ করলেও মনে মনে সে ভিন্নমতাবলম্বীর টুঁটি টিপে ধরছি।  পলিটিকাল ডিসকোর্সে অবশ্য এমন 'ইকো চেম্বার' ব্যাপারটা আধুনিক ফেনোমেনা নয় বলেই আমার ধারণা, তবে সোশ্যাল মিডিয়া যে ব্যাপারটাকে 'ম্যাগনিফাই' করেছে তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। 

তবে এই ইকো-চেম্বারের পরিসরে বাস করেও, যাবতীয় তর্কবিতর্ক হইহট্টগোলের মধ্যে থেকেও; কয়েকটা ব্যাপারে বোধহয় নিশ্চিন্তে ফোকাস করা যায়; 

১। মতামত (ওপিনিওন) এ'দিক ও'দিক দৌড়ঝাঁপ করতেই পারে কিন্তু 'ঘটনা এবং পরিসংখ্যান'; এই ব্যাপারটা অমোঘ এবং নিশ্চল। সে'খানে 'গ্রে এরিয়া'র সুযোগ নেই। ইকো-চেম্বার থেকে ওপিনিওন গ্রহণ করার প্রসেস নিশ্চয়ই নিন্দনীয় নয়। হারারি সাহেব জোরালো সুরে বলেছেন; 'গসিপ' ও 'দলবাজি' ছিল বলেই আজ হোমোস্যাপিয়েনরা   গোরিলাদের মত জংলি-জীবনে আটকে না থেকে রিট্যুইট-মার্কা আধুনিক হতে পেরেছে। কাজেই ওপিনিওন গ্রহণ ব্যাপারটা অস্বাভাবিক নয় কিন্তু ইকো-চেম্বার থেকে 'অব্জেক্টিভ' খবরের বদলে গোঁজামিল ডেটা জোগাড় করলেই সমূহ বিপদ। এবং সেই বিপদকে তেমন পাত্তা না দিয়ে আমরা রীতিমতো খতরো কি খিলাড়ি হয়ে পড়ছি। আর খতরো কি খিলাড়ি হয়ে আমাদের ইতিহাস-জ্ঞান অত্যন্ত সরেস হয়ে উঠছে। ক্লাবের আড্ডায় কানাইদা বলেছে হরিহর সামন্তর দাদু রবীন্দ্রনাথের মানিব্যাগ চুরি করেছিলেন অতএব গোটা পাড়া জানল সামন্তরা দাড়ি-বিরোধী জোচ্চোরের বংশ। এদিকে সামন্য খোঁজখবর করলেই জানা যেত যে হরিহর সামন্তর দাদুর মৃত্যু ঘটে রবীন্দ্রনাথের জন্মের আগে এবং জোয়ান বয়স থেকে মরার দিন পর্যন্ত পর্যন্ত  লম্বা দাড়িয়ে দুলিয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন তিনি। হতে পারে সামন্তরা দিনে সুদখোর ও রাতে সিঁদকাটিয়ে; সত্যিই তাঁরা আদর্শ জোচ্চোর এবং পাড়ার ইকো-চেম্বারের ওপিনিওন নেহাত ফেলনা নয়। কিন্তু সঠিক কারণ না টেনে স্রেফ হরিহরের দাদু দাড়ি-বিরোধী বলে সামন্তদের জোচ্চোর বলাটা বিশ্রী এবং বিষাক্ত। ইকোচেম্বারে ওপিনিওনের ভীড় ঠেলে ডেটা তুলে আনা চাট্টিখানি কথা নয়, তুলে আনায় রগরগে মজাও নেই। কিন্তু মাঝেমধ্যে খেটে তর্ক করলে ব্যাপারটা মন্দ দাঁড়ায় না।

২। আমার ধারণা দলমত নির্বিশেষে সমস্ত রাজনৈতিক নেতা যেটা চান সে'টা হল তাদের সমর্থকদের হোয়াটাবাউটারি এক্সপার্টে পরিণত করা। মোটের ওপর নিশ্চিন্ত হয়ে বলতে পারি এ কথা; পলিটিকাল ফ্যানডমের সেল্ফ-অ্যাকচুয়ালাইজেশন রয়েছে ওই একটি ব্যাপারেই। রাজনৈতিক দলের কর্মীরা নিজেদের হোয়াটাবাউটারিতে সঁপে দেবেন সে'টা স্বাভাবিক। কিন্তু সাধারণ সমর্থক হয়ে সে'টা শুরু করলেই নারায়ণ দেবনাথিও ভাষায় যাকে বলে "চিত্তির"। 

তমুক নেতার সমর্থক - "অমুক নেতা চোর"।
অমুক নেতার সমর্থক - "তমুক নেতা ডাকাত"।

তমুকের ডাকাতির আশ্বাসে অমুকের চুরিজোচ্চুরি পাপের ভার লাঘব হয় যায় না। কিন্তু সমর্থকদের এই লাগামছাড়া গুঁতোগুঁতি গোছের তর্ক বোধ হয় অমুকনেতা এবং তমুকনেতা দু'জনের জন্যই সুবিধেজনক। এ'টুকু হাসিলের জন্যেই তাদের যাবতীয় সভা, মিটিং, মিছিল ও বাতেলা। 

"অমুক চোর কিনা" এ প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলে যদি দু'দিকের সমর্থকই শুধু অমুককে নিয়েই আলোচনা করেন; তা'হলে বাস্তবিকই অমুকনেতা ও তমুকনেতা দু'জনেই ফাঁপরে পড়বেন। কারণ হোয়াটাবাউটারি বাদ গেলেই ওপিনিওন ফিকে হয়ে  মজবুত হবে 'অবজেক্টিভ ইনফর্মেশন'। আর সমর্থকরা অব্জেক্টিভ হলে যে নেতাদের দুশ্চিন্তা বাড়বে তা বলাই বাহুল্য। 

উপরোক্ত দু'টো কথা পেরিয়ে এ'বার একটা জরুরী (এবং ব্যক্তিগত)  'ওপিনিওন-বায়াস' প্রসঙ্গে আসি। এই 'বায়াস'গুলো সম্ভবত ফেলনা নয়, নয়ত মতাদর্শগত লড়াইগুলো মরে যাবে। কিন্তু মতাদর্শগুলোকে অযৌক্তিক বিষোদগারের বাইরে টেনে এনে ভ্যালিডেট করা যাবে কী ভাবে? 

প্রথমত, মতাদর্শের পক্ষে দাঁড়ানো মানে সেই মতের পক্ষে 'ফ্যাক্ট'কে দুমড়েমুচড়ে দেওয়া নয় বা ইনফর্মেশন যাচাই না করা নয়। লম্বা দাড়ি ও রবীন্দ্রনাথের পক্ষ নিতে গিয়ে হরিহরের সামন্তর দাদুর ঘাড়ে মিথ্যে দোষ চাপিয়ে দেওয়াটা চাপের; আর তার দোষ লম্বা দাড়ি বা রবীন্দ্রনাথের নয়, দোষ রয়েছে তর্কবাগীশের যুক্তিবোধে।

দ্বিতীয়ত, মতাদর্শ 'কন্সিস্টেন্ট' না হলে নারায়ণ দেবনাথিও ভাষায় যাকে বলে 'আইইকস'। অমুকচন্দ্র নেতার ঘামাচিতে নাইসিল দেব আর তমুকচন্দ্র নেতার ঘামাচিতে বিছুটি; তা'তে সেই হোয়াটাবাউটারি ফিরে আসতে বাধ্য।

তৃতীয়ত, সম্পদ আর ক্ষমতা যার হাতে; তার জবাবদিহির দায় অবশ্যই বেশি। এটা অবশ্যই অকাট্য সত্য নয়, নিতান্তই একটা মতামত (ওপিনিওন')।  কিন্তু ওই; ইতিহাস সম্ভবত এম্পিরিকাল থাপ্পড় কষিয়ে প্রমাণ করে দেয় যে এই জবাবদিহির নিয়মে গোলমাল মোটেই অভিপ্রেত নয়। চোখাচোখা প্রশ্নগুলোর বেশিরভাগই যে সরকার বাহাদুরকে তাক করে ছুঁড়তে হবে (কেন্দ্রীয় সরকার / রাজ্যসরকার; যার জোর যত বেশি, তার দায়ভারও ততটাই) , সে'টাই স্বাভবিক। এর অন্যথা হলেই নারায়ণ দেবনাথিও ভাষায় ব্যাপারটা যাকে বলে "ইররক....গেলুম রে"।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু