Skip to main content

জুতোবাজ



এক বন্ধু রেকমেন্ড করেছিল 'বিসনেস ওয়ার্স' পডকাস্ট। পেপসি-কোকের পর নাইকি এবং অ্যাডিডাসের বাজারদখলের লড়াই নিয়ে রোমহষর্ক কয়েকটা এপিসোড শুনেছিলাম। আর তার কয়েকদিনের মাথায় নজরে পড়ল এই বইটা; নাইকির ফিল নাইটের আত্মজীবনী। সোজাসাপটা ভাষা, কিছু কিছু জায়গায় প্রায় ডায়েরির মত গড়গড়িয়ে লেখা। আর সোজাসাপটা লেখার যে কী গুণ; মনে হয় টেবিলের ও'পাশে বসে কেউ গল্প বলছেন। এ চ্যাপ্টার থেকে ও চ্যাপ্টার যাওয়ার সময় মনে হয়; "এক মিনিট স্যার, চট করে চানাচুরের ডিবেটা নিয়ে আসি"।

এ'বারে র‍্যান্ডম অবজার্ভেশনগুলোঃ

১. আমেরিকানদের খেলাধুলোর প্রতি আগ্রহের সঙ্গে আমাদের কিছুতেই তুলনা চলে না। আগাসি বা ফিল নাইটরা ব্যতিক্রমী, তাঁদের দৃষ্টান্ত দিয়ে গড়পড়তা আমেরিকানদের বিচার করা অবশ্যই অনুচিত।  কিন্তু এই দু'জনের আত্মজীবনী পড়ে  বুঝেছি যে সে'দেশে স্পোর্টস ব্যাপারটা সিস্টেমের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে ভাবে মিশে আছে; বিশেষত শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে। এবং সবচেয়ে বড় কথা হল অলিম্পিয়ান বা সেলেব্রিটি হওয়ার লোভটুকুই স্পোর্টসের শেষ কথা নয়। আগাসির টেনিস বা নাইটের দৌড় নিয়ে গল্প লেখা হয় বটে কিন্তু তাঁরাই শুধু ক্রীড়াবিদ নন। অফিস ফেরতা মানুষের জগিংয়ে বেরোনো বা ব্যাডমিন্টন খেলতে যাওয়ার মধ্যেও রয়েছে সার্থকতা; সে'খেলাটুকুও সিরিয়াসলি নেওয়ার দরকার আছে, সে'টুকু খেলার মধ্যেও নিয়ম আর ভালোবাসা টিকিয়ে রাখাটা জরুরী। বিভিন্ন চাপে যতবার ফিল নাইট পর্যুদস্ত বোধ করেছেন; ততবার তিনি দৌড়েছেন মাইলের পর মাইল। ফিল নাইট ব্যবসায়ী হিসেবে যতটা সফল, তাঁর জীবন ততটাই সার্থক ক্রীড়াবিদ হিসেবে; যদিও তেমন মেডেলটডেল কোনোদিনই জোটাতে পারেননি তিনি।

২. প্রতিটা সফল ব্যবসার গল্প যত্ন করে বলতে পারলে বোধ হয় এমন কিছু রোম্যান্টিক  মুহূর্ত, অ্যাডভেঞ্চার ও ঘুরে দাঁড়ানোর রূপকথা ভেসে উঠবে যা যে কোনো নভেলের কান মুলে দিতে পারে। ফিল বড় যত্ন করে সমস্ত গল্প বলেছেন। কফিকাপ হাতে বারান্দায় বসে যে সুরে গপ্প ফাঁদা উচিত, সে'ভাবেই।

৩. ক্রমশ বিশ্বাস মজবুত হচ্ছে যে আত্মজীবনীতে নিজের কথা বলার চেয়ে ভালো স্ট্র‍্যাটেজি হচ্ছে আশেপাশের মানুষগুলোর কথা গুছিয়ে বলা। ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, রাগ, প্রতিশোধ,  হাসিঠাট্টা; সমস্ত ফিল্টার দিয়ে নিজের চারপাশের মানুষগুলোকে স্পষ্টভাবে দেখাতে পারলেই নিজের জীবনের গল্পটা দিব্যি বলা হয়ে যায়; এবং স্টাইল হিসেবে সে'টাই মনোগ্রাহী। ফিল এই কাজটা খুব ভালোভাবে করেছেন। প্রায় গোটা বই জুড়েই নিক একজন অবসার্ভার; ব্লুরিবন থেকে নাইকি হয়ে ওঠার গল্প এগিয়ে চলে অন্যদের সাফল্য আর ব্যর্থতায় ভর দিয়ে।

৪. ফিল বহু বছর লড়াই করবেন নিজের বাবার চোখে পুত্র-গর্বের ঝিলিক দেখতে।  আর বহু বছর পর বুঝবেন যে সে লড়াইটা অদরকারী ছিল। তবে সে যাত্রাপথটা অদরকারী ছিল না। আর সে যাত্রাপথের শেষ প্রান্তে এসে তাঁর নিজের চোখ ঝাপসা হয়ে আসবে নিজের বৃদ্ধ পিতার জন্য গর্বে। ফিলের বাবা ছিলেন ভুলেভ্রান্তিতে ভরা, ঠিক ম্যাথুর বাবার মতই। ম্যাথু কে? ফিল নাইটের বড় ছেলে, যার অকালমৃত্যুর ধাক্কা সহ্য করত হবে নাইটকে।

৫. নাইকির মাধ্যমে কিছু জবরদস্ত বন্ধু জুটিয়েছিলেন ফিল। নাইকির সাফল্য সে'সব বন্ধুত্বের গল্পও বটে। আর বড় চিত্তাকর্ষকভাবে সে'সব বন্ধুদের কথা বলেছেন ফিল। বন্ধুদের সাহায্যে  নাইকি তৈরি করেননি ভদ্রলোক, বরং নাইকির মাধ্যমে খুঁজে পেয়েছেন সে'সব বন্ধুদের। খুঁজে পেয়েছেন জীবনসঙ্গিনীকে। এমন কি নাইকি নামটাও ফিলের দেওয়া নয়, বরং স্বপ্ন হাতড়ে সে নাম পেয়েছিলেন তেমনই এক বন্ধু। পড়তে দিব্যি লাগে সে'সব গল্প।

৬. জাপানি ও মার্কিনীদের তফাৎ, মিল ও ব্যবসায়িক রসায়ন নিয়ে বেশ জরুরী কিছু কথা রয়েছে এ বইয়ে।

৭. এক্সেলেন্সের প্রতি আনুগত্য; আমার আদৌ নেই। কিন্তু জবরদস্ত  মানুষজনের থাকে। সে জন্যেই আজকাল বিভিন্ন বায়োগ্রাফি পড়ার চেষ্টা করছি।  ভালো লাগে, মাঝেমধ্যে গায়ে কাঁটা দেয়। এক্সেলেন্সের একটা বড় দিক বোধ হয় মানুষকে সম্মান করতে পারা। এই একটা গুণের জন্যেই হাজার গলদ সত্ত্বেও  ফিল নাইটরা ব্যতিক্রমী; এ জন্যেই হয়ত তাঁদের জীবনী হয়ে ওঠে 'গ্রিপিং'। সেল্ফ-হেল্প বই আমার ধাতে সয় না, কিন্তু এ'বইগুলো বেশ চমৎকার।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

ব্লগ-বাজ

আর চিন্তা নেই । বাঙালিকে আর রোখা যাবে না । আর সামান্য (সম্ভবত কিঞ্চিত গোলমেলে ) কবিতা ছাপাবার জন্যে সম্পাদক কে তোল্লাই দিতে হবে না । আর প্রেমে লটরপটর হয়ে ডায়েরি লিখে প্রাণপাত করতে হবে না। পলিটিক্স কে পাবলিক-জন্ডিস বলে গাল দেওয়ার জন্য আর “প্রিয় সম্পাদক” বলে আনন্দবাজারের ঠ্যাং ধরতে হবে না। কেন ?  হোয়াই? বাঙালি ব্লগিং শিখে গ্যাছে যে। ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে শাণিত তলোয়ারের মত “ পোস্ট”-সমূহ জনতার ইন্টেলেক্ট এসপার-ওসপার করে দেবে ; হাতে-গরম গায়ে-কাঁটা। বাঙালি মননের নব্য জিস্পট ; ব্লগ-স্পট । কে বলে যে বাঙালি ব্রিগেডে বুক্তুনি দিয়ে আর ফুটবল মাঠে খেউড় করে খতম হয়ে গ্যাছে ? কে বলে যে বাঙালির ঘিলু কফি হাউসে ভাত ঘুমে মগ্ন ? বাঙালিকে একবার ব্লগখোর হতে দিন , সমস্ত অভিযোগ ভ্যানিশ হয়ে যাবে । পোপ থেকে পরশুরাম ; ডেঙ্গু থেকে মশাগ্রাম ; বং-ব্লগের দাপট রইবে সর্বত্র । বাঙালির সমস্ত আশা-ভরসা-জিজ্ঞাসা এইবারে ব্লগ মারফত্‍ পৌছে যাবে ট্যাংরা ট্যু টেক্সাস । তোপসে মাছের স্প্যানিশ ঝোলের রেসিপি কী ? বাঙাল-ঘটি মিল মহব্বত-হয়ে গেলে কি বাঙ্গালিয়ানা চটকে যাবে ? নেতাজী কি এখ

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু