Saturday, July 28, 2018

চন্দ্রগুপ্ত

- এই যে, আর কতক্ষণ এ'খানে বসবে?
- যতক্ষণ, ততক্ষণ।
- ও মা, হেঁয়ালি করছ নাকি। রাত এগারোটা বাজে। শেষ লঞ্চ চলে গেছে। জেটি ফাঁকা। দোকান বন্ধ হবে যে। বেঞ্চি উলটে রাখব। এ'বার সরে পড়ো দেখি।
- খদ্দের তাড়িয়ে দিচ্ছ গো? ধর্মে সইবে খুড়ো?
- ভারী আমার খদ্দের এলেন রে৷ গোটাদিন বেঞ্চি আটকে কী নিলে? দু'কাপ চা আর তিনটে বিড়ি। কত করে বললাম; নাও একবাটি ঘুগনি, নয়তো একজোড়া ডিম সেদ্ধ। সে বালাই নেই। ধুত্তোর। আর এই শোনো, আমায় ধর্মকর্ম শেখাতে এসো না বুঝলে। আমার বৌয়ের ঠাকুরের আসনে শিবে, কালীতে, যীশুতে এক ঘাটে জল খায়, অথচ এত গদগদ ভক্তি ফলিয়েও লাভ কী হয়েছে? সে বেচারি গোটাদিন বাতের ব্যথায় জেরবার।
- তুমি কমিউনিস্ট নাকি খুড়ো?
- লেনিনপুজোর নিয়মকানুন তো সন্তোষীমার ব্রতকেও হার মানায় হে। নাহ্, পুজোঅর্চনা আমার জন্য নয়। তবে হ্যাঁ, কোয়ালিটি চা আর আলমগঞ্জের সেরা ঘুগনি খেতে চাইলে নদীর ধারে আমার এই ভাঙাচোরা দোকানে না এসে উপায় নেই।
- বাবাহ্ খুড়ো। তোমার কী দেমাক।
- দেমাকের আর কী দেখলে হে। দেমাক দেখেছি হরেন মাছওলার। নতুন খদ্দের কাতলার কানকো তুলে কোয়ালিটি চেক করতে যেতেই সে কী মুখচোপা। তার কাছে বাজে মাছ পাওয়া গেলে সে নাকি ক্ষতিপূরণ হিসেবে সোনার আংটি দেবে, এমন নোটিস টাঙিয়ে মাছ বিক্রি করত সে।
- বলো কী।
- তবে আর বলছি কী। ভেজালের যুগে কোয়ালিটি চাইলে সামান্য মেজাজ সহ্য করতে হবে বইকি। তা তুমি তো এ পাড়ায় নতুন মালুম হচ্ছে।
- আমার নাম চন্দ্রগুপ্ত। আমার ঘরদোর নেই। যে'দিন যেমন। আজ খুড়োর বেঞ্চি পেলাম। অমৃতসমান চা খেলাম। পকেটে দু'টো টাকা বেশি থাকলে ঘুগনিও খেতাম।
- ভিখিরির নাম চন্দ্রগুপ্ত। বটে। তা বাবা চন্দ্রগুপ্ত,  তোমার হাবভাব তো ভিখিরির নয়? বয়সও কলেজে পড়ার।
- খুড়োর চোখে তো নয়, ছুরি। নিজেকে স্রেফ একতাল মাখন মনে হচ্ছে।
- বাপের প্যাঁদানি?
- আসলে...।
- প্রেমের গাঁট্টা?
- আমি কোন হনু খুড়ো, আমি কী আর প্রেমট্রেম বুঝি।
- ওহ্, ন্যাকাও বটে। তা শোনো, পত্রপাঠ বেঞ্চি খালি করো। আর ওই উনুনের পিছন দিকে ডেকচিতে ঘুগনি পড়ে আছে। রাতের খাওয়া হয়ে যাবে। ডিম আছে, সেদ্ধ বসালেও পারো। উনুন নেভেনি এখনও। সঙ্গে ওই পাউরুটি। খেয়ে উদ্ধার করো। আর দোকানের মেঝেতে আজকের রাতটা কাটিয়ে দাও। একটা মাদুরও আছে। বালিশ চাইলে পুলিশে দেব। খবরদার যদি আর বেঞ্চে বসেছ, এখুনি বেঞ্চ উলটে রাখো। দোকান বন্ধ মানে বেঞ্চি উলটো। 
- তুমি জোর করছ যখন আজ রাতটা এখানেই কাটিয়ে দিই। কিন্তু জানো খুড়ো, ব্যাপারটা ঠিক প্রেমের গাঁট্টা নয়। মেয়েটা বড় ভালো, আমিই অপদার্থ।
- সে আমি বুঝেছি। আর শোনো ভোরবেলা আমি না আসা পর্যন্ত দোকান ছেড়ে বেরোবে না। সকাল সাড়ে ছ'টায় প্রথম লঞ্চ, আমি ছ'টার আগে এসে উনুন ধরাবো। কেমন? ও কী জেটির কাছে গোলমাল কীসের? এখন আবার লোক জড়ো হয়েছে কেন?
- এত রাত্রে আবার গোলমাল কেন? চোরটোর নাকি?
- আমি গিয়ে দেখে আসি। তুমি খাওয়াদাওয়া কর গে। খবরদার, ফিরে এসে যেন বেঞ্চি সোজা না দেখি।

জেটিতে এসে খুড়ো টের পেলেন কাণ্ডটা। কাছেই একটা দিনতিনেকের পুরনো মড়া ভেসে উঠেছে, জলপুলিশের একটা নৌকা সেই লাশ তুলে এনেছে। লাশটা চন্দ্রগুপ্তের। ও'দিকে দূরে তার দোকানটা তখনও হ্যারিকেনের আলোয় আবছা দেখা যায়; একটা আবছায়ার মত মানুষ বেঞ্চি উলটে রেখে ঘুগনির ডেকচির দিকে এগিয়ে গেলো।

মৃদু হাসলেন খুড়ো। এখন ফিরে গিয়ে চন্দ্রগুপ্তের খাওয়ায় ব্যাঘাত ঘটানোর কোনো মানে হয়না।  তিনি বুঝলেন প্রেম আস্বাদন না করে ব্যর্থ প্রেমিকের আত্মা এ পৃথিবী ছাড়তে চাইবে না। তবে নিজের রান্না ঘুগনির ওপর সম্পূর্ণ আস্থা আছে খুড়োর।

No comments: